শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন
-মঈন চিশতী
হাল আমলে ইসলামের বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আমল বা কর্মসূচি নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ বিতর্কের মূল উদ্দেশ্য যে মানুষকে ধর্ম-কর্ম থেকে বিমুখ করা সেদিকে আমাদের কারও নজর নেই। আজকাল একটি শ্রেণী যারা বেনামাজিকে নামাজি বানানোর কোনো বাস্তব কর্মসূচি না রেখে যারা নামাজি তাদের নামাজে দ্বোয়াল্লিন-জ্বোয়াল্লিন আমিন আস্তে বলা জোরে বলা ইত্যাদি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। ফলে মানুষ নামাজের ব্যাপারে উদাসীন থেকে যাচ্ছে।
কোনো এক অঞ্চলে দ্বোয়াল্লিন-জ্বোয়াল্লিন নিয়ে দুই দলের ঝগড়া যে যাকে বাগে পায় হাটুরে কিল কিলায়। এক লোক হাট থেকে বাড়ি ফিরছে, জ্বোয়াল্লিন নিয়ে ক্ষেপা এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করছে ওই মিয়া তুমি নামাজে দ্বোয়াল্লিনের পক্ষে না জ্বোয়াল্লিনের পক্ষে?
উত্তরে লোকটি বলে ভাই আমি নামাজই পড়ি না। ক্ষেপা লোকটি বলে যাও তোমার ব্যাপারে কথা নেই। আমাদের মনে রাখা দরকার, ধর্মের বিভিন্ন কর্মধারা ঐশী বিধান হলেও তা বাস্তবায়নের কর্মপদ্ধতি মানুষের সংস্কৃতি এবং মানুষের অভ্যাসের ওপর নির্ভরশীল করে তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি মুবাল্লেগিনরা আমাদের শিখিয়েছেন; যা আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ অঞ্চলে শবেবরাতের আনুষ্ঠানিকতা তেমনই একটি মুসলিম সংস্কৃতি। সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। আর সভ্যতার উৎস ধর্ম এবং সামাজিক বিধি-নিষেধ। একটি আরেকটির পরিপূরক। প্রতিটি দেশ, সমাজ এবং গোত্রের ধর্মে ভিন্নতা থাকলেও সংস্কৃতি প্রায় এক। আবার সংস্কৃতির বিকাশ এবং প্রচার ঘটে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উৎসব ও পূজাপার্বণ ইত্যাদির মাধ্যমে।
এ অঞ্চলে ইসলামে মুবাল্লিগ বা ধর্ম প্রচারকরা লক্ষ করে দেখেছেন, এখানে আদি ধর্মাবলম্বীরা বারো মাসে তেরটি পার্বণ পালন করে। এসব ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উপলক্ষে শিশু-কিশোররা নানা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। ধর্ম বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। আর বয়স্করা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে ধর্মীয় বিষয়াদি পালন করেন। এ অঞ্চলের আদি ধর্মাবলম্বীরা সাড়ম্বরে জন্মাষ্টমীর মিছিল পালন করত। ইসলাম প্রচারকরা খেয়াল করলেন এর বিকল্প মুসলিম সমাজে কিছু দিতে না পারলে মুসলিমরা ভিন্নধর্মীদের আয়োজনে যোগ দেবে। কারণ মানুষ স্বভাবতই নানা আচারানুষ্ঠানে উৎসাহী। তাই তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের জশনে জুলুস বা ঈদে মিলাদুন্নবীর মিছিল, আর দেয়ালি বা হোলি মিছিলের জায়গায় ঈদের আনন্দ মিছিলের আয়োজন করে।
যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের সবাই সাড়ম্বর অংশগ্রহণ করত। এছাড়াও ছিল মুসলিম শিয়া সম্প্রদায়ের মহররমের শোক বা তাজিয়া মিছিল। এগুলোই মুসলিম সংস্কৃতির অংশ। কেননা মুসলিম ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায় তা আয়োজন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বলে আমাদের জানা নেই। শবেবরাতও তেমন একটি ধর্মীয় সামাজিক আচার অনুষ্ঠান। শুধু তাই নয়, এটি বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতি যেমন একটি ধর্মগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে, তেমনি শবেবরাতও বাঙালি মুসলমানের পরিচয় বহন করে। কেননা মুসলিম ছাড়া ভিন্ন ধর্মীয়রা তা পালন করে না। যেমনি মহররমের মিছিল শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কেউ পালন করে না। মহররমের শোক মিছিল থেকে সাধারণ মুসলমানরা যে আহলে বাইতের প্রেমের প্রেরণা পেত তা ভুলিয়ে রাখতে একটি শ্রেণী একে বিতর্কিত করে তার সর্বজনীনতাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এ অঞ্চলে হাজার বছর ধরে পালিত মহররমের মিছিল এ বিতর্কের কারণে ইউনেস্কোর হেরিটেজ রেকর্ডভুক্ত হতে না পারলেও এ সেদিন মাত্র শুরু হওয়া বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর হেরিটেজ রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোতে তা পালনের জন্য নির্বাহী আদেশ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আলেম ওলামারা কোনো ধর্মীয় বিতর্ক ও জোরালো সমালোচনা করেছেন বলে দেখিনি, পড়িনি! অথচ এ মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি ভিন্ন ধর্ম সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।
আলোচনা হচ্ছিল শবেবরাত নিয়ে। আসলে শবেবরাত কী? সহজ ভাষায় এর অর্থ সৌভাগ্য রজনী। অনেকে বলেন, ভাগ্য তো পূর্বনির্ধারিতই, আবার শবেবরাতে কীসের ভাগ্য? অথচ আল্লাহ বলেন, ‘ফিহা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকিম (এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরিকৃত হয়) এ আয়াতের লাগসই ব্যাখ্যা এক ভ্রাম্যমাণ মসজিদের চাঁদা কালেক্টরের জবানে শুনলাম। তিনি বাসে উঠে সালাম দিয়ে বলেন, ‘আজ শাবানের চার তারিখ, সামনে শবেবরাত, আমাদের রিজিক বণ্টনের রাত। অনেকে হয়তো বলবেন, রিজিক তো পূর্বনির্ধারিত, শবেবরাতে আবার কী? দেখেন! সরকার আপনাদের নামে গম বা চাল বরাদ্দ করলেও আপনাদের হাতে পৌঁছতে ছয় থেকে দশ মাস লেগে যায়। তেমনি আমার তকদিরের আগামী এক বছরে রিজিকও আল্লাহ ফেরেশতাদের মাধমে এ রাতে বণ্টন করে দেন। শবেবরাতের আমলগুলো : নবী পাক (সা.) বলেন, তুবা লিমাই ইয়ামাল ফি লাইলাতিন নিসফি ফিশশাবান, সেই ব্যক্তির জন্য পরম সৌভাগ্য এবং খুশির কথা যে ব্যক্তি শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে ইবাদতে লিপ্ত থাকে।
হজরত আবুল কাসেম আফফার একদিন খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমাকে (রা.) স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে নবী দুহিতা খাতুনে জান্নাত আপনার প্রতি কী বকশিশ করলে আপনি সর্বাধিক খুশি হন?
জবাবে খাতুনে জান্নাত বলেন, শাবান মাসের মধ্যবর্তী শাবানে আট রাকাত নফল নামাজ আমি বেশি পছন্দ করি, এ নামাজ আদায়ের নিয়ম হল, একইসঙ্গে আট রাকাতের নিয়ত করবে, প্রতি দু দু রাকাতের বৈঠকে তাশাহুদের পর দরুদ শরিফও পাঠ করবে, প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহার পর এগারোবার সূরা এখলাস পাঠ করবে। হে আবুল কাসেম এ নিয়মে আট রাকাত নামাজ আদায় করে আমার ওপর সোয়াব রেসানি করলে হাশরের ময়দানে তার জন্য সুপারিশ না করে আমি জান্নাতে যাব না’। এসব নফল ইবাদত ছাড়াও রাতব্যাপী তসবিহ-তাহলিল, জিকির, তেলাওয়াত, সালাতুল হাজত, সালাতুততাসবিহ, উমরি কাজা নামাজ আদায় করা যায়। শবেবরাতের মর্যাদা : শবেবরাতকে মাগফিরাতের রাতও বলা হয়। ইমাম আহমদের বর্ণনায় নবী (সা.) ইরশাদ করেন অর্ধ শাবান বা শবেবরাতের রাতে বান্দাদের প্রতিই রাব্বুল আলামিন করুণার নজরে তাকান, মুশরিক এবং হিংসুক ছাড়া সবার গুনাহখাতা আল্লাহ মাফ করে দেন। এছাড়া নবী পাক (সা.) বলেন, কুমু লাইলা অয়া সুমু ইয়াওমাহা (হে মুমিনরা তোমরা শাবানের মধ্যবর্তী রাতে জেগে ইবাদত কর এবং পরের দিন রোজা রাখ। কেননা এ রাতটি খুবই বরকত এবং মর্যাদাপূর্ণ। কেননা এ রাতে আল্লাহ নিচের আসমানে এসে বলতে থাকেন হাল মিম মুস্তাগফিরিন? ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ আছ কি?, হাল মিম মুস্তারজিকিন? রিজিকপ্রার্থী কেউ আছ কি? আল্লাহ পাক আমাদের শবেবরাতের আমলগুলো পুরোপুরি পালন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
Leave a Reply