শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২২ পূর্বাহ্ন
জগন্নাথপুর নিউজ ডেস্ক::
সিলেটে মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হলেও বিষয়টি প্রথমে গোপন রেখে ‘সাধারণ মাদকের মামলা’ করা হয়। ঘটনা যাতে জানাজানি না হয়, এজন্য আহত দুই পুলিশ সদস্যকে কোনো হাসপাতালে না নিয়ে ব্যারাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এমনকি ঘটনা রাত আড়াইটায় ঘটলেও মামলায় ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয় রাত সাড়ে ৪টা। অভিযোগ উঠেছে, কোতোয়ালি থানার ওসি এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মিলে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিষয়টি দফারফা করেছেন।
যদিও তারা দু’জনই এটি অস্বীকার করেছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
২৭ মে নগরীর বন্দরবাজার এলাকার কাষ্টঘরের সুইপার কলোনিতে এ ঘটনা ঘটে। কলোনির পুরনো কোয়ার্টারের ২য় তলায় নওজোয়ান লালের কক্ষে ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে- এমন খবর পায় পুলিশ।
রাত ২টার পর কোতোয়ালি থানার এসআই (ডিউটি ইনচার্জ) মো. আকবর হোসাইন ভুঁইয়া, এসআই মো. ফায়াজ উদ্দিন ফয়েজ, এএসআই সঞ্জয় চন্দ্র দে, গোলাম রসুল, কনস্টেবল জীবন কর্মকার দে’সহ ১২ সদস্যের টিম সেখানে অভিযানে যায়।
অভিযানে ১০০ পিস ইয়াবাসহ জিয়া আরমান চৌধুরী ও ৫০ পিস ইয়াবাসহ ডালিম মিয়াকে আটক করে পুলিশ। জিয়া সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট (উত্তর মাহুতহাটি) গ্রামের মো. আলা উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ও শহরতলির নয়াবাজারের আল ইসলাহ’র বাসিন্দা।
আর ডালিম সিলেট সদর উপজেলার রাজারগাঁওয়ের বাচ্চু মিয়ার ছেলে ও নগরীর শামীমাবাদের সেলিম মিয়ার কলোনির বাসিন্দা। এ সময় পরোয়ানাভুক্ত আসামি কাষ্টঘরের শংকর লালের ছেলে রুবেল লালকেও গ্রেফতার করা হয়।
জিয়া, ডালিম ও রুবেলকে থানায় নিয়ে আসার সময় সুইপার সরদার রাম বাবু ও আজগরের নেতৃত্বে মাদক ব্যবসায়ীরা বাধা দেয়। একপর্যায়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ধাওয়া দিলে ডিউটি ইনর্চাজ এসআই আকবর, ফয়েজসহ পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে পালিয়ে যায়।
এ সময় মাদক ব্যবসায়ীদের ছোড়া ইটে মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান এএসআই সঞ্জয়। অজ্ঞান অবস্থায়ও সঞ্জয়কে মারধর করে মাদক ব্যবসায়ীরা। তাকে উদ্ধার করতে গেলে কনস্টেবল জীবনকে মাথায় বাঁশ ও রড দিয়ে আঘাত করে তারা।
রডের আঘাতে জীবনের ডান চোখের ওপরের অংশ ফেটে রক্ত বের হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে প্রথমে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগেই সঞ্জয় ও জীবনকে হাসপাতাল থেকে ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এ দুই পুলিশ সদস্য বর্তমানে ব্যারাকে চিকিৎসাধীন।
ওসমানী হাসপাতালের রেজিস্ট্রার সূত্র জানায়, ২৭ মে রাত ২টা ৪৫ মিনিটে এসএমপি কোতোয়ালি থানার ঠিকানা দিয়ে জীবন কর্মকার দে ও সঞ্জয় চন্দ্র দে নামের দু’জন রোগী ভর্তি হন। তারা হাসপাতালের ৪নং ওয়ার্ডের বেড নং- এক্সট্রা ১৬১’তে সঞ্জয় ও ১৬২’তে জীবন চিকিৎসা নেন। সঞ্জয়ের রেজি নং- ১৬১১০ ও জীবনের ১৬১০৯।
পরদিন তারা হাসপাতাল থেকে স্বেচ্ছায় চলে যান। সোমবার সকালে বিষয়টি সমাধানের জন্য ১০ লাখ টাকা নিয়ে থানায় ঘুরাঘুরি করে সুইপার সরদার রাম বাবু, আজগর, মাদক ব্যবসায়ী খোকন ও নওজোয়ান।
কোনো উপায় না পেয়ে তারা যায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে। মেয়র আরিফ তাদের কোনো প্রশ্রয় না দিয়ে বলেন, তোমরা পুলিশকে মারধর করেছ, এত সাহস কই পাও? আমার কিছু করার নেই। বিষয়টি স্বীকার করে তিনি যুগান্তরকে বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বলেছি।
আরিফের কাছে আশ্রয় না পেয়ে তারা সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের কাছে যায়। কামরান এবং কোতোয়ালি থানার ওসি গৌছুল হোসেন মিলে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে বিষয়টি দফারফা করেন।
পরে পুলিশ এসল্ট মামলা না করে ‘সাধারণ মাদক মামলা’ করা হয়। মামলায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার কোনো বর্ণনাই নেই। এছাড়া ঘটনা রাত আড়াইটায় ঘটলেও মামলায় ঘটনার সময় রাত ৪টা ২০ মিনিট উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানের খবরে বুধবার রাতেই এসএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামেন। আহত দুই পুলিশ সদস্যকে ডেকে পাঠান। তাদের কাছে ঘটনার বিবরণ এবং তাদের শরীরের আঘাত দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
সেই সঙ্গে অপরাধীদের নামে দ্রুত মামলা দায়েরের জন্য কোতোয়ালির ওসিকে নির্দেশ দেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে ঘটনার তিন দিন পর বুধবার রাতে পেনাল কোডের ১৪৩/৩৪১/৩৩২/৩৩৩/৩৫৩/১৮৬/১১৪ ও ৩৪ ধারায় মামলা রের্কড করেন ওসি গৌছুল।
তবে বুধবার গভীর রাতে দুপুরের সময় দিয়ে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। মামলায় সুইপার সরদার আজগর ও মাদক ব্যবসায়ী নওজোয়ানকে প্রধান করে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়।
সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ১০ লাখ টাকার বিষয়টি অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার দিন ফজরের নামাজের আগে সুইপাররা আমার কাছে এলে আমি কোতোয়ালি থানার ওসির সঙ্গে আলাপ করেছি মাত্র।
ঘটনায় উভয়পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিরীহ সুইপার ও দু’জন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। দফারফা হয়েছে কিনা, সেটা তারাই বলতে পারবেন। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না বলে জানান। এ ব্যাপারে কোতোয়ালি থানার ওসি গৌছুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো দফারফা হয়নি। ভুয়া খবর। বুধবার দুপুরেই মামলা নিয়েছি।’
অথচ বুধবার দুপুরে যুগান্তর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এবং থানার মুন্সি শাহ আলম এ মামলার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। শুধু মাদকের মামলার তথ্য দিয়েছিলেন। এদিকে রাতে মামলা করে দুপুরের সময় উল্লেখ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এটিও সত্য নয়।’
Leave a Reply