সামিউল কবির
সকালের চা-আর বিস্কুটের সাথে সম্পর্ক আমার এক যুগের উপরে। প্রতিদিনের মতো এদিনও সকালে রং চায়ের বুকে বিস্কুট ডুবিয়ে খেয়েই সোজা বাজারে। বন্ধুদের সাথে বাজারেই কাটে জীবনের কিছু আনন্দঘন সময়। দেশে তখনও করোনা ভাইরাসের সাক্ষাৎ মেলেনী। যাইহোক বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর যেকোন দেশে থাকুন না কেন আড্ডা তাদের মারতেই হবে, আড্ডা ছাড়া যেন তাদের পেটের ভাতও হজম হয়না। এর মধ্যে পৃথিবীর বড় বড় দেশে করোনা ভাইরাস কঠিন রুপ ধারন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ইতিমধ্যে এটাকে বিশ্ব মহামারী হিসেবে ঘোষনা দিয়েছেন। বিশ্বে যখন লাখে লাখে মানুষ মরছে তখনই আমাদের দেশের মানুষ খোড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাসের ভুলি আওড়াচ্ছেন, যে না এটা আমাদের দেশে আসবেনা, এটা আসছে ইহুদী খ্রীষ্টান দেশের মানুষের জন্য। তবে গল্পের আবদুল জলিল চাচা ছিলেন এখানে খুব ব্যতিক্রম। তিনি ব্যতিক্রম তো হবেনই,,যৌবনে জীবনে জীবিকার ধান্দায় মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসেছেন। তখনকার পঞ্চম শ্রেনী পাশ জলিল চাচা। জলিল চাচা মনে করেন রোগ কোন ধর্ম চিনেনা যে কে কোন ধর্মের কোন বিশ্বাসের। একদিন ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোন করোনা শনাক্ত হয়। ভাইরাসের সাথে লড়তে লড়তে প্রায় তিন মাস অতিবাহিত করলো বাংলাদেশ। বর্তমানে বঙ্গ দেশে করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ, ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ১০০০ এর মতো উপরে মানুষের।
ভাইরাসের প্রদূর্ভাবে বিপর্যয় পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনীতির। ৮ সন্তানের জনক জলিল চাচাও এর মধ্যেই পড়েছেন,,মধ্যপ্রাচ্য গিয়ে চাচা যা সম্পদ বানিয়েছিলেন ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত একমাত্র ছেলের চিকিৎসায় তা হারিয়ে চাচাও আজ দিন মজুরের ন্যায়। শুরুতে করোনা ভাইরাসের সময় যাও কিছু মানুষ সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন, এখন আর আগের মতো নেই।
–
পরিবারে একমাত্র আয় রোজকারী ব্যক্তি হিসবে ১০ জন মানুষের সংসার কিভাবে টেনে যাবেন বহুদূর? অভাবের সংসারে চাচা বড় অসহায়! বয়সও চাচার ৭০,, আর কি শরীর চলে? এমন অবস্থায় ওয়ার্ড মেম্বারও আর খবর নেন না, যদিও প্রথম প্রথম তিনি খবর নিয়েছিলেন।
–
একদিন সত্যি সত্যি এই কঠিন দুর্যোগের সময় চেয়ারম্যান সাহেব এর বাড়ি থেকে চাচার ডাক পড়লো, জলিল চাচা গিন্নি কে বলেন, গিন্নি শুনছো চেয়ারম্যান সাব আমারে ডাকছে,, এবার মনে হয় আমরা কিছু খোরাকি পাবো, যাক কিছুদিন অন্তত বেঁচে থাকা যাবে।
–
জলিল চাচা ডাকেন, চেয়ারম্যান সাহেব বাড়িতে আছেন নি? চেয়ারম্যান সাহেব বলেন আসেন চাচা আসেন, বাবা আমারে ডাকছেন বুঝি? অয় বা,
কিতার লাগি বা?
–
চেয়ারম্যান সাহেব বলেন চাচা, দেশে যে করোনা ভাইরাস আইছে ইতা থেকে বাঁচলে আমাদের লগে কিছু জিনিস রাখা দরকার! আর তার মধ্যে বড় উল্লেখযোগ্য হলো এই মাস্ক। আমি আজকে এটা দিলাম আপনারে, এটা পড়ে আপনি বাড়ির বাহিরে বের হবেন। তখন আপনি সুরক্ষিত থাকবেন। করোনা ভাইরাস আপনাকে আর আক্রমন করতে পারতোনা। আর চাচা এদিকে আসেন আমি যে আপনাকে এই মাস্ক টা দিলাম তাই একটা ছবি উঠাই!
–
জলিল চাচা; বুঝছি বাবা এটা খুব দরকারি। কিন্তু বাবা ঘরে যে আমার খাবার নাই তার কি হবে?
–
দেখেন চাচা সরকার থেকে যে সাহায্য বরাদ্দ হয়েছে, এটা আমাদের হাতে এসে পৌছায় নি, আচ্ছা আমার পকেট থেকে আপনাকে ৫০০ টাকা দিলাম। যাবার সময় বাজার নিয়ে যেয়েন বাড়িতে।
–
জলিল চাচা, খুশি মনে বলেন আল্লাহ তোমার হায়াত দান করুক বাবা। বাজার করে জলিল চাচা বাড়িতে দিকে রওয়ানা দিলেন.. কিন্তু চাচার মুখে মাস্ক দেখে আশে পাশের সবাই হাসাহাসি করেছে চাচা সেটাও বুঝতে পেরেছেন।
–
দেশে লকডাউন চলছে চাচার আয় রোজকার বন্ধ। কিভাবে বেঁচে থাকবেন সামনের এই কঠিন দিনগুলো এই ভাবনায় সময় যায়। সরকারের বিশেষ বরাদ্দে চাচার নামও আছে। তাও চেয়ারম্যান সাব নামটা মায়া করে দিয়েছিলো বিধায়।
–
জলিল চাচার একটাই মাস্ক তাই ধুয়ে টুয়ে এটা বারবার পড়েন, ইশ! যদি আরও কয়েকটা মাস্ক থাকতো! একদিন মাস্ক পড়ে জলিল চাচা গ্রামের বাজারে গেলেন মাছ কিনতে, গিয়ে দেখেন মানুষের মধ্যে কোন সচেতনতা নাই, কারো মুখে কোন মাস্ক নাই। এসব কি? বিষয়টি চাচার মনে বাধলো খুব। পথে দুই যুবক কে চাচা প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মাস্ক কই? উল্টো চাচা কে নিয়ে এই যুবকদ্বয় হাসাহাসি করলো অনেকক্ষন। চাচা আবার প্রশ্ন করেন এই তোমরা হাসছো কেন? যুবকদ্বয় বলে.. ‘মালেক কুল মউত আসলে ঘরে থাকলে মরমু’ ইতা মাস্ক টাস্ক লাগাইয়া লাভ নাই!
–
জলিল চাচা বলেন ; ঠিক আছে এরপরও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আমাদের প্রিয় নবী বলেছেন কোন দেশে যখন মহামারী আসবে তখন তোমারা যে যেই স্থানে আছেন সেই স্থানেই অবস্থান করবে; এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে যাওয়া যাবেনা। দুই যুবক মনে হয় কথাগুলো মনেতেই নিলোনা!
–
ভারাক্রান্ত মনে জলিল চাচা, গিন্নি কে বলেন – শোন গিন্নি প্রিয় স্বদেশ ভাল নেই; বাজারে গিয়া আজ যা থাকলাম! মানুষের কি একটু হুশ জ্ঞান নেই। পরে গিন্নি কে মাস্ক টি ধুয়ে দিতে বলেন। গিন্নি শুকানোর জন্য মাস্কটি উঠানে একটি রশির উপর রাখলেন। একসময় মাস্কটি আর কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গিন্নি বলেন মাস্কটি তো এই রশির উপরই রাখছিলাম! তাহলে গেলো কই? জলিল চাচা ও গিন্নি চিন্তায় পড়ে গেলেন; তাদের পরিবারের জন্য আজ একটি মাস্ক কত যে দরকার! মাস্ক টি কই গেলো তাহলে? বুঝি মাস্কটি চুরি হয়ে গেলো?
–
সারা গ্রামে রটে গেলো বিষয়টি, যে আব্দুল জলিল চাচার মাস্ক চুরি হইগিছে! চাচার মাস্ক হারিয়ে যাবার খবর শুনে চাচার পাশে দাড়িয়েছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। পরে চাচা আরও কয়েকটি মাস্ক যদিও পেয়েছেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছে না উনার প্রথম মাস্কের কথা! উনার মনে ভাবনা উদয় হয় কেন একটি মাস্ক এভাবে চুরি হয়ে যাবে? তাছাড়া মানুষদের সচেতন করতে গেলে কেন তাহারা ঠাট্টা বিদ্রুপ করবে?
–
সময়ের পরিক্রমায় পুরো গ্রাম আজ করোনা আক্রান্তে ভরে গেছে; প্রশাসন থেকে মাইকিং করছে। বিশ্ব করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে গেছে, এলাকা কে রেড় জোন ঘোষণা করা হইছে; সাবধান সবাই বাড়িতে থাকুন, প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না। যদি ঘর থেকে বাহির হতেই হয় তাহলে সাথে মাস্ক নিয়ে বের হন।
–
জলিল চাচার নিজ গ্রামে করোনা আক্রান্তের প্রকোপে দেখে গ্রামের মানুষের মধ্যে এখন কিছুটা ভয় কাজ করছে। চাচা মনে করেন..যদি গ্রামের মানুষজন অন্তত এভাবে আরও দুই মাস আগ থেকে ভয় নিয়েই সচেতন হতো তখন এই গ্রামে এতো আক্রান্ত আমাদের দেখতে হতো না।
–
জলিল চাচা মনে মনে বলেন যে গ্রামে প্রথম মাস্ক পড়েছিলাম আমি, তখনই গ্রামের মানুষ আমাকে নিয়ে কত হাসাহাসি করছিলো! আজ গ্রামের অনেকেই তো মাস্ক পড়ছেন, ভাল লাগছে দেখে।
লেখক; সাংবাদিক।
Leave a Reply