সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১২ পূর্বাহ্ন
জগন্নাথপুর নিউজ ডেস্ক :: রাত ৩ টা। ঝালকাঠি সুগন্ধা নদীর উপর দিয়ে বরগুনা যাচ্ছিল এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি। গভীর ঘুমে যাত্রীরা। হঠাৎই লঞ্চে আগুন। মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো অংশে। জেগে থাকা যাত্রীরা জীবন বাঁচাতে ছুটছেন দিগবিদিক। তাদের চিৎকার আর আর্তনাদ তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। ঘুম ভেঙে যায় নদীর দুই তীরের মানুষেরও।
ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে অভিযান-১০। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো নদীটিও আলোকিত হয়ে পড়ে। অনেকেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যান। কেউ কেউ কোনো উপায় না পেয়ে নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের একটি অংশ সাঁতার কেটে উপরে উঠে আসলেও অনেকে পানিতে ভেসে গেছেন। তখনো চলছিলো লঞ্চ। নলছিটি উপজেলার সরই গ্রাম থেকে কোনাবালিয়া ইউনিয়নের দিয়াকুল পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকায় চলে এ তাণ্ডব। ভোর সাড়ে ৪টা। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে ফায়ার সার্ভিস। ততক্ষণে সব পুড়ে শেষ। উদ্ধার কাজে নামে সংস্থাটি। পানিতে থাকা যাত্রীদের উদ্ধারে নামে স্থানীয়রা। ছোট ছোট নৌ-যানে করে তাদের উদ্ধার করা হয়। এ সময় অনেককেই আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। সকাল ৭ টা। লঞ্চ থেকে একের পর এক বের করে আনা হয় মরদেহ। রাখা হয় ঝালকাঠি পৌর মিনি পার্কে। সেখানে ভিড় করেন আশপাশের মানুষ। ক্রমেই স্বজনের খোঁজে আসতে শুরু করে বেতাগী, পাথারঘাটা ও বরগুনার মানুষ। কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। স্থবির পুরো ঝালকাঠি শহর। এগিয়ে আসে আইনশৃখলা বাহিনী। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এগিয়ে আসে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো। এরইমধ্যে বাড়তে থাকে অগ্নিদগ্ধদের সংখ্যা। অনেককে নেয়া হয় হাসপাতালে। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত ৩৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মরদেহগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় হতাহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
জানা যায়, নলছিটি উপজেলার সরই গ্রাম এলাকা অতিক্রম করার সময় মাঝ নদীতেই লঞ্চটির ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। এ সময় অসংখ্য যাত্রীরা দগ্ধ হন। প্রাণে বাঁচতে অনেক যাত্রীই নদীতে ঝাঁপ দেন। তাদের অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। খবর পেয়ে বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠির কোস্টগার্ডসহ ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট উদ্ধার কাজ করছেন। দগ্ধদের মধ্যে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে শতাধিক ও ৭২ জনকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিরা আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গতকাল বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক কামাল হোসেন ভূঁইয়া হতাহতের তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সাইদুর নামের এক যাত্রী জানান, রাতে ঢাকা থেকে বরগুনা ফিরছিলাম। লঞ্চটি ঝালকাঠি গাবখান এলাকায় পৌঁছালে ইঞ্জিনরুমে আগুন লেগে যায়। এরপর সে আগুন পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়। প্রাণে বাঁচতে নদীতে ঝাঁপ দেন অনেক যাত্রী। নদী পাড়ে অপেক্ষায় থাকা আমেনা খাতুন জানান, তার ভাই ঢাকা থেকে এ লঞ্চে করে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না।
উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া স্থানীয়ারা জানান, লঞ্চের নিচ তলায় ও ২য় তলায় অসংখ্য মানুষের হাড় ও মাথার খুলি দেখা গেছে। উদ্ধার হওয়া অধিকাংশ মরদেহগুলো লঞ্চের কেবিনে পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পুরো লঞ্চটি রক্তাক্ত। লঞ্চের ডেকে জুতাসহ ভস্মীভূত বিভিন্ন জিনিসপত্র এলোমেলো পড়ে আছে।
তালতলি ছোট বগি গ্রামের জলিল সিকদার বলেন, আমার ছোটবোন, মা ও ২ ভাগ্নি ঢাকা থেকে অভিযান-১০ লঞ্চে করে বাড়িতে আসছিলো। ভোররাতে বোন ফোনে কল দিয়ে জানালো লঞ্চে আগুন লেগেছে। এর পরে আর কিছু বলতে পারেনি। পরবর্তীতে ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম ঝালকাঠি এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। ছুটে আসলাম। আহত অবস্থায় বোনকে পেয়েছি। মাকে ও দুই ভাগ্নিকে পাইনি। আমার বোন এখন দিশাহারা। কোথায় পাবো মা ও ভাগ্নিদের। তারা নিচতলায় ছিল। মা ও ভাগ্নিদের লাশও পাচ্ছি না।
ইসমাইল হোসেন বলেন, আমার ভাই ও ভাবী, আমার বড় আম্মাকে নিয়ে ঢাকা থেকে লঞ্চে আসছিলো। হঠাৎ করেই আগুন লাগছে। তখন আমার আম্মা ভাস্তিকে নিয়ে লঞ্চের কিনারে আসছে। পানিতে লাফিয়ে পড়ছে তারা। তারা বেঁচে গেলেও ভাই ও ভাবীকে পাচ্ছি না। তারা নিখোঁজ। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেটাও জানি না।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হাফেজ মো. ইদ্রিস মানবজমিনকে বলেন, আমার বাবাকে পাচ্ছি না। আমরা লঞ্চে ছিলাম। ঢাকা থেকে আমার বাচ্চাসহ ৫ জন লঞ্চে উঠি। বাবাকে একটা লোক ২য় তলায় নিয়ে শুয়েছে। আর আমার মা, বউ ও বাচ্চা নিয়ে একত্রে ছিলাম। আগুন লাগলে বউ চিৎকার দেয়। আমি ভেবেছিলাম লঞ্চ ডুবে যাচ্ছিল। তবে কিছুক্ষণ পরে আগুনের তাপ পেয়ে বুঝতে পারি। বউ আমার মাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। পরে আমাকে নিয়ে পানিতে লাফ দেয়। আমি চোখে দেখিনা। বাবার খোঁজও নিতে পারছি না। বাবাকে ছাড়া সবাইকে পেয়েছি। বাবার খোঁজে এখানে শুয়ে আছি।
৩৬ জনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন:
অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩৬ জনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে ঝালকাঠির সিভিল সার্জন। সিভিল সার্জন ডা. রতন কুমার ঢালী মানবজমিনকে বলেন, ঝালকাঠি হাসপাতালে ৩৬ জনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। আমরা সন্ধ্যার পরে পুলিশের কাছে সব লাশ বুঝিয়ে দিয়েছি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগ লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শরীর ও মুখ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় লাশ শনাক্ত করতে পারছেন না স্বজনরা। যদিও সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয়জনের লাশ স্বজনরা শনাক্ত করেছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শরীর ও মুখ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় লাশ শনাক্ত করতে পারছেন না স্বজনরা।
এদিকে দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ সময় নিহতের প্রতিটি পরিবারকে দেড় লাখ টাকা ও দাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে এবং অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসার সকল ব্যয় সরকার বহন করার কথা জানান। এর আগে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ। জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী জানায়, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।
ওদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি আমির হোসেন আমু ঘটনার সংবাদ পেয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্ধার কাজে সহযোগিতার নির্দেশ দেন। তিনি এ মর্মান্তিক ঘটনায় হতাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। একই সঙ্গে আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার নির্দেশ দেন।
লঞ্চের মালিক যা বললেন: বিস্ফোরণের পর এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে ওই নৌযানের মালিক ও বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার লঞ্চ মালিক হাম জালাল গণমাধ্যমকে বলেন, লঞ্চের কেরানি আনোয়ার ভোর রাত ৩টার ৫ মিনিটে তাকে ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। সে বলেছে দোতলায় একটা বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন দেখা যায়। তারপর তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। গভীর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী ওই লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৩৮ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়েছেন আরও বহু যাত্রী। নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে লঞ্চ মালিক হাম জালাল বলেন, ওই লঞ্চে অন্তত ২১টি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ছিল, কিন্তু এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে যে সময় পাওয়া পায়নি। একটি পাইপ গেছে ইঞ্জিন থেকে। সেখানে প্রথম বিস্ফোরণ হয় বলে আনোয়ার আমাকে জানিয়েছে। হাম জালাল এমভি অভিযান-১০, ৩ ও ৫ লঞ্চের মালিক। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান তিনি। ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের অংশটি বেশি পুড়েছে। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা। ওই লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী আবদুর রহিম জানান, রাতে ডেক থেকে তিনি হঠাৎ বিকট শব্দ পান। তারপর লঞ্চের পেছন দিক থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে দেখেন। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন পুরো লঞ্চ গ্রাস করে ফেলে। আতঙ্কিত হয়ে তিনি ডেক থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। নদীর পাশের দিয়াকুল গ্রামের লোকজন নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিচ্ছিলেন। তারাই আবদুর রহিমকে উদ্ধার করে গরম কাপড় দেন। পরে সকালে তাকে ট্রলারে করে ঝালকাঠি শহরে নেয়া হয়।
Leave a Reply