বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন
ডা. সাঈদ এনাম ::
স্বপ্ন কি? আমরা কেন স্বপ্ন দেখি? স্বপ্ন কি কেবল আমরা ঘুমের মধ্যে দেখি? স্বপ্ন কি ভবিষ্যতের জন্যে কোন গুরুত্ব বহন করে?
স্বপ্ন হলো অতীতের কিছু স্মৃতি, অভিজ্ঞতা বা কোন ঘটনার সঙ্গে একেবারে নিকট বর্তমানের কিছু স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, ভাবনা বা কোন ঘটনার সংমিশ্রণে তৈরি একটি লাইভ ছোটগল্প।
ছোটগল্প কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ছোটগল্প হলো, ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’। সুতরাং স্বপ্ন হলো ছোট গল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি লাইভ ছোট নাটিকা। যার সুনির্দিষ্ট কোন উপসংহার হয় না।
আর লাইভ নাটিকাটির পরিচালক হলো আমাদের ‘সাব-কনশাস মাইন্ড’। সাব-কনশাস মাইন্ড তার সংগহে থাকা মুহূর্ত, অভিজ্ঞতা, ভাবনা, আর স্মৃতিগুলোকে ইচ্ছেমতো জুড়ে দিয়ে তৈরি করে এক পর্বের একটি সারমর্ম, সারাংশ, উপসংহার ছাড়া সরাসরি নাটিকা। যিনি স্বপ্ন দেখেন সাব-কনশাস মাইন্ড তাকেই প্রধান চরিত্রটি দেয়।
স্বপ্নের সঙ্গে ভবিষ্যতের কী সম্পর্ক?
এর উত্তরে আগে জানি ভবিষ্যৎ কী? ভবিষ্যৎ হলো অতীত ও বর্তমানের অভিজ্ঞতা, ঘটনাপঞ্জি ও স্মৃতির সমন্বয়ে একটি রেললাইন উপর ধীরে ধীরে বয়ে চলা কর্মফল। সুতরাং স্বপ্নের সঙ্গে ভবিষ্যতের ঘটনার ছোটখাটো একটা যোগসূত্র থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কেন স্বপ্নের সঙ্গে বর্তমানের খানিকটা মিল পাওয়া যায়। স্বপ্নের সঙ্গে স্থান-কাল-পাত্রের হুবুহু মিল পাওয়াকে নিউরোসাইকিয়াট্রির ভাষায় বলে ডিজা রেভি। অর্থাৎ যিনি স্বপ্ন দেখেন তার কাছে মনে হয়, ‘ঠিক এই জায়গাটি বা এই লোকটিকে গত রাতে স্বপ্নে দেখেছি’।
আমাদের ব্রেইন বেশি পরিশ্রম করে অতীতে ঘটে যাওয়া কোন মুহূর্তকে ভুলে যেতে। কোন কিছু মনে করতে ব্রেইনকে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না।
স্বপ্ন দেখার পরদিন যদি মনে হয়, কোথায় যেনো মিলে যাচ্ছে- তাহলে বুঝতে হবে স্বপ্নে যা দেখা হয়েছে সেটা অতীতের ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা যা ব্রেইনের স্মৃতি সেন্টার থেকে মুছে গিয়েছে। অবচেতন মনের তৈরি স্বপ্ন সেই ভুলে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে পুনরায় যুগসূত্র দাঁড় করিয়ে দিল।
স্বপ্ন কি কেবল ঘুমের মধ্যেই?
হ্যাঁ। আমরা স্বপ্ন ঘুমের মধ্যেই কেবল দেখি। ঘুম দুই প্রকার। র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ (REM sleep) অর্থাৎ ঘুমের সময় চোখ নড়াচড়া করা এবং নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ ( Non REM sleep) অর্থাৎ যখন ঘুমের সময় চোখ স্থির থাকে। আমরা স্বপ্ন দেখি মূলত REM sleep এর সময়ে। স্বপ্নকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না তবে আধোঘুমের স্বপ্নকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একে লুসিড ড্রিম বলে।
স্বপ্ন নানান রকম হতে পারে। সুখের, দুঃখের, হাসি বা কান্নার। জন্মান্ধ মানুষ বা বধির ও স্বপ্ন দেখেন। তবে তাদের স্বপ্ন কিন্তু সাদাকালো বা শব্দহীন নয়। তাদের স্বপ্ন আমাদের মতোই বর্ণিল, রিনিঝিনি ছন্দময়। এমনকি জন্ম থেকে প্যারালাইজড রোগী ও স্বপ্নে দৌড়াতে বা খেলতে দেখেন তাঁকে।
স্বপ্ন ভয়ের হতে পারে। স্বপ্নের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সাদৃশ্য আছে। চাকরি প্রার্থী স্বপ্ন দেখেন তিনি চাকরি পেয়েছেন বা পেয়েও ষড়যন্ত্রে পড়ে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন! তাই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠেন ঘুম থেকে। প্রেমে পড়া তরুণ-তরুণী স্বপ্নে দেখেন, স্বপ্নের মানুষ দৌড়ে দৌড়ে এসে সামনে পড়ে হাঁপাচ্ছে আর হাঁপাচ্ছে। অথবা স্বপ্নে দেখছে মনের মানুষটি চম্পট দিয়েছে অন্য কোনো লম্পটের সঙ্গে।
ভয়ের স্বপ্ন সবাই দেখে। ভয়ের স্বপ্ন দেখি যদি আমরা কোন টেনশন বা দুশ্চিন্তায় থাকলে, কোন বিপদগ্রস্থ থাকলে। ভয়ের স্বপ্ন বেশি দেখে শিশুরা। আট থেকে বারো তেরো বয়সের এবং কখনো কখনো তারা স্বপ্নের মধ্যে চিৎকার করে উঠে।
শেষ করি এক গল্প দিয়ে। একবার চেম্বারে এক ভদ্র মহিলা এলেন স্বামীকে নিয়ে। অভিযোগ ঘোরতর। স্বামী নাকি প্রায়ই ঘুমের মধ্যে তাকে চড় থাপ্পড় আর কিল ঘুষি মারেন। মার খেতে খেতে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। না পেরে নিয়ে আসছেন স্বামীকে।
ভদ্র মহিলার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার, বিষয় কি সত্যি?’।
তিনি কেঁদে কেটে সৃষ্টিকর্তার দোহাই দিয়ে যা বললেন তা অনেকটা এরকম,
“গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে তিনি স্বপ্নের দেশে চলে যান। বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ান। অতঃপর হঠাৎ দেখেন কোথা থেকে কখনো বাঘ কখনও বা ভাল্লুক এসে তাড়া করছে তাকে।
এক পর্যায়ে শুরু হয় ‘বাঘে-মানুষে’ বা ‘ভাল্লুকে-মানুষে’ যুদ্ধ। চলতে থাকে বাঁচা-মরার যুদ্ধ। যার পুরোটাই যায় পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীর ওপর দিয়ে!
যাইহোক ‘স্লিপ হাইজেন’ এবং কয়েক সেশন কাউন্সেলিংয়ে তাদের সে সমস্যা কেটে যায়। মহিলা যারপরনাই খুশি হন স্বামীর সুস্থতায়।
লেখক: ডা. মো. সাঈদ এনাম, সাইকিয়াট্রিস্ট
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।
Leave a Reply