বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৩ অপরাহ্ন
মহামারী করোনার প্রভাবে অতিষ্ঠ আমাদের দৈনন্দিন জীবন। দেড় বছরেরও অধিক সময় করোনার অত্যাচারে আমরা গৃহবন্দি। জীবনের শখ, আহ্লাদ সবকিছুই বরবাদ হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে সারি সারি লাশ। আপনজনদের হারিয়ে ফেলছি এক নিমিষে। চোখের সামনেই অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করে মারা যাচ্ছে কতই না প্রিয়জন। মৃত্যুভয় আমাদের চরমভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। সেজন্য চোখের সামনে কেউ মরতে লাগলেও সহজে আরেকজন আগায় না। কারণ একটাই করোনা রোগীর সংস্পর্শে করোনা হবে। আর করোনা হলেই মৃত্যু। তাই আজকাল মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলেও আপনজনের সেবা, সহানুভূতি খুবই কম পাচ্ছে। তাকে হতে হচ্ছে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত। পাচ্ছে না ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা। একটু আদর-যত্নের অভাবেই ধুঁকে ধুঁকে মরছে তারা। সন্তান তার জন্মদাতা পিতা-মাতাকেও ভয়ে ছুঁতে চায় না। স্বামী ছোঁয় না স্ত্রীকে, স্ত্রী ছোঁয় না স্বামীকে, বোন ছোঁয় না ভাইকে। এ কেমন ভয়ানক দৃশ্য! যেখানে সেখানে ফেলে রাখছে লাশগুলো। আপনজনরাও নিচ্ছে না। করোনার ভয়ে লাশ ফেলেই পালিয়ে যাচ্ছে। পরিচয় দিচ্ছে না নিজের আপনজনের। ফলে মৃতদের হচ্ছে না জানাজাটুকুও। কী ভয়ানক, কী মর্মান্তিক মৃত্যু!
করোনা হলে কোয়ারান্টিন আবশ্যক। হয় সেটি বাড়িতে নয়তো হাসপাতালে। যাদের তেমন শ্বাসকষ্ট থাকে না তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারে। বাড়ি থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চিকিৎসা নিলেই ভালো হয়। এসময় রোগীদের বেশি দরকার মানসিক সাপোর্ট। একটা মানুষ ১৪ দিন একটানা একাকী গৃহবন্দি থাকলে তো অতিষ্ঠ হবেই। তারপর আছে মৃত্যুভয়। চারপাশের মৃত্যুভয়, আতঙ্ক তাকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। তাই এসময় তার একান্ত আপনজনদের আদর-যত্ন খুবই প্রয়োজন।
অধিকাংশ মানুষ ভাবে করোনা হলেই মৃত্যু অবধারিত। আরও ভাবে করোনা রোগীকে ধরলেই করোনা হবে। কিন্তু না, এ ধারণা ঠিক না। চিকিৎসায় করোনা ভালো হচ্ছে। সুস্থতার হারও বেশি। গত ২৬ জুলাই এর রিপোর্ট অনুযায়ী সুস্থতার হার বেড়েছে ৯৮.০৫ শতাংশ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তাদের করোনা কাবু করতে পারে না। এরা একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারে। যেসকল রোগী বয়স্ক, যাদের শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, ম্যালাইটাস, কিডনি ডিজিজ, হৃদরোগ থাকে তারাই বেশি আক্রান্ত হয়। তাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারা করোনার কাছে হেরে যায়। এসব রোগীদের বেলায় করোনা আবার সহজে ধরাও পড়তে চায় না। সাধারণত ন্যাজাল সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা করলে বেশিরভাগই নেগেটিভ আসে। কিন্তু এইচআরসিটি টেস্ট করলে ঠিকই পজিটিভ আসে।
করোনা রোগীকে ধরলেই করোনা হয় না। বরং করোনা রোগীর সংস্পর্শে গেলে করোনা হতে পারে। যেমন- করোনা রোগীর হাঁচি, কাশি, লালা দ্বারা করোনা ছড়াতে পারে। তবে এসেপটিক টেকনিক মেনে চললে তারও ঝুঁকি কম থাকে। সতর্ক থাকলে আর স্বাস্থ্যবিধি মানলে করোনা তেমন সংক্রমিত হয় না। তাই আমাদের এসব ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে- চিকিৎসায় করোনা ভালো হয়, করোনা হলেই মৃত্যু নয়।
করোনা আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে সবসময় ভালো ব্যবহার করতে হবে। তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। তার সঙ্গে গল্পগুজব করতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে। পাশে থাকতে না পারলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার খোঁজখবর নিতে হবে। তাকে মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমো ইত্যাদি মাধ্যমে তার সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রাখতে হবে। সর্বোপরি, তাকে এ্যাসুরেন্স করতে হবে- করোনা ভালো হয়। তার যে করোনা হয়েছে সে যেন এটি ভুলেই যায়। সে যেন সবার মতো স্বাভাবিক থাকতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাকে কখনো অবহেলা অথবা এড়িয়ে চলা যাবে না। কেননা, মানসিক সাপোর্ট পেলেই রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়। একটা মিষ্টি হাসি, একটু মিষ্টি কথা, একটু সহানুভূতি ওষুধের চেয়েও দ্রুত কাজ করে। তাই করোনার চিকিৎসায় মানসিক সাপোর্ট খুবই জরুরি। রোগীকে আগেই মানসিকভাবে সুস্থ করতে হবে, তাহলে করোনাও তাকে ছেড়ে পালাবে। বিশেষ করে কাছের মানুষ, পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোন নিজেরা নিজেদের সঙ্গ দিতে হবে।
একজনের করোনা হলে আরেকজন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। নিজের সেফটি বজায় রেখে তার সেবা করতে হবে, মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। তার থেকে তিনফুট দূরত্ব বজায় রেখে, মুখে মাস্ক পরে, সঠিকভাবে হাত ধুয়ে তাকে সঙ্গ দিতে হবে। বিশেষ করে যারা একটু শিক্ষিত, সচেতন আর মানবিক তারা এগুলো করে। আর যারা মানুষ হয়েও অমানুষ তারাই নিজের স্বার্থের জন্য আপনজনদেরও ত্যাগ করে। রক্তের বাঁধন অস্বীকার করতে তাদের এক সেকেন্ডও সময় লাগে না।
শহরের মানুষ সচেতন, জানে, বোঝে এবং চিকিৎসাও নেয়। তারা চালাক-চতুরও হয়। তাই মানসিক দিকটা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এদিক থেকে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা খুবই করুণ। গ্রামে কারও সিজনাল সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, জ্বর হলেও মানুষ করোনা ধরে নেয়। যার ফলে তাদের এড়িয়ে চলে। এমনকি গুজবের রেশ ধরে সেই বাড়িতে লকডাউনও দিয়ে দেয়। একদিকে তারা ভয়ে করোনা টেস্ট করায় না। আবার অন্যদিকে লকডাউনের যন্ত্রণা। তাহলে কতটা মানসিক চাপ যায় তাদের ওপর? না পারে মন খুলে কাউকে বলতে, না পারে সইতে। ঘরে বসে চুপি চুপি নাপা, ফিক্সো, অ্যান্টিবায়োটিক খেতে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই মেডিসিন খায় তারা। এতে ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি হয়। এভাবে ধুঁকে ধুঁকে তারা তাদের ফুসফুসটাকে ড্যামেজ করে। কারণ শাস্বকষ্ট হলে তো আর অক্সিজেন, নেবুলাইজ এগুলো তারা পায় না। ধৈর্য ধরে, চাপে পড়ে, ভয়ে-ভয়ে মেডিসিন খায়। শেষপর্যায়ে যখন আর না পেরে ওঠে, ফুসফুস আর কাজ না করে তখনই বাধ্য হয় হাসপাতালে যেতে। কিন্তু তখন আর সময় থাকে না। ফুসফুস মরমর হয়ে যায়, তার কার্যক্ষমতাও কমে যায়। ফলে হসপিটালাইজড হওয়ার আগেই তাদের শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়। এভাবেই নীরবে ধুঁকে ধুঁকে মরে গ্রামের বোকাসোকা সহজ-সরল মানুষগুলো। না পায় সঠিক চিকিৎসা, না পায় মানসিক সাপোর্ট। তাই গ্রামসহ সর্বসাধারণকে বোঝাতে হবে করোনা হলেই মৃত্যু নয়, চিকিৎসায় করোনা ভালো হয়।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মানে এই নয় কোভিড রোগীকে অবহেলা করা, মানসিক চাপে রাখা। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, তিনফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশির সময় সতর্ক থাকতে হবে। করোনা রোগীর সেবা করতে হবে শারীরিক, মানসিক দুইদিক থেকেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে শারীরিক সেবার থেকে মানসিক সেবাই বেশি জরুরি। মানসিক সাপোর্ট নিশ্চিত হলেই করোনার সংক্রমণ অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
মেহেরুন ইসলাম : সিনিয়র স্টাফ নার্স, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply