শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:৪২ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
নির্ধারিত জায়গায় সুবিপ্রবি ক্যাম্পাস দ্রুত স্থাপনের লক্ষে সংবাদ সম্মেলন আব্বাকে মনে পড়ে  সুনামগঞ্জে কর্মী সম্মেলন সফলের লক্ষে জগন্নাথপুর জামায়াতের প্রচার মিছিল জগন্নাথপুরে তারুণ্যের উৎসবের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ  জগন্নাথপুরের স্বাস্থ্য ও রুচিসম্মত খাবারের নিশ্চয়তায় উদ্বোধন হলো মেজবান রেস্তোরাঁ ইংল্যান্ডের বার্ণলী সিটির সাবেক কাউন্সিলর কমিউনিটি নেতা মুজাক্কির আলীর স্বদেশ আগমন শান্তিগঞ্জে তারুণ্যের উৎসবের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ  জগন্নাথপুরে এনআইডি জালিয়াতির অভিযোগে নির্বাচন কর্মকর্তাসহ আটক ২  শান্তিগঞ্জে বরেণ্য শিক্ষাবিদ আব্দুর রউফ এর স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত শিক্ষাবিদ মো. আব্দুর রউফ’র স্মরণ সভা আজ

আব্বাকে মনে পড়ে 

 

আমার আব্বা মারা যান ২০২২ এর ১লা ফেব্রুয়ারি, এই ২৫ শে- তাঁর মৃত্যুর তিন বছর হয়ে গেল! কিন্তু খুব কম দিন গেছে তাঁকে ভুলে থাকতে পেরেছি। তাঁর কথা ও এর সংক্রামের প্রতিটা মনস্তাত্ত্বিক তুল্যবিন্দুতে তিনি অবশ্য এখন ভিন্নভাবে এসে উপস্থিত হন। বুকের মধ্যে তখন গভীর একটা হাহাকার অনুভব করি। এইসব মুহূর্তে তাঁর শূন্যতা যাপন করা সন্তান হিসেবে আমার জন্য সহজ কথা নয়। জীবিত এই মানুষটার থেকে তাঁর এই অনুপস্থিতি বলতে গেলে এখন সর্বক্ষণের সঙ্গী। এখানে তাঁর এই মৃত্যুর পরও দেখা যাচ্ছে তিনি মারা যাননি এবং আমাদের মধ্যে স্মৃতিতে থেকে গেছেন বলতে হয়।

 

যদিও আব্বার মৃত্যুর পর নিজের কাছে এই আমি এখন পুরো আলাদা মানুষ, আর আগের মতে নই। বেশ বুঝতে পারি তাঁর এই ভিন্নতর উপস্থিতি ও সংলাপে তিনি এর মধ্যে অস্তিত্ব জুড়ে একটা জায়গা করে নিয়েছেন। স্বভাবত আমার যা ব্যক্তিবৈশিষ্ট, তর্কপ্রিয় মন, যার অনেকটা তাঁর প্রযত্ন ছাড়া নির্মাণ ছিল অসম্ভব, এখানে দেখছি সেটা থাকছে না। এভাবে আমার মধ্যে তাঁর নিবিড় একটা প্রভাব ও উপস্থিতি হয়ে উঠছে এখন প্রবল এবং প্রতিস্থাপনধর্মী। জানি না লোকেরা এটাকে কি না বলে জীবনের পরম্পরা, এখন বলতে গেলে আমি সে রকম এক দায় যাপনে আছি। জীবন এখানে আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা স্মৃতিসত্তা ছাড়া আর কিছুই না।

 

তাহলে এখানে সেই স্মৃতিসত্তার কিছুটা বয়ান করি। যদিও এর আগে আব্বাকে নিয়ে আমি একটা গদ্য লিখেছি। এখানে চেষ্টা করবো এসব যাতে পুনর্ব্যক্ত না হয়। আসলে আমার আব্বা একটা সাংস্কৃতিক জীবন কাটিয়ে গেছেন। এখানে সে নিরিখে তাঁর জীবনচরিত বয়ান করতে পারলে বেশ খুশি হতাম। আপাত সেটা একটু কঠিন বটে। বলবো আমার কাছে তাঁর দার্শনিক টাইপটা পছন্দের হলেও একেবারে বিচারহীন ছিল না। তিনি আমাদের তুমূল ভাবতে সাহায্য করতেন ঠিক, বিকল্প কী হতে পারে এর অনেকটা সহজে দেখিয়েও দিতেন; তবুও যুগের সংস্কার অতিক্রমণ ছিল তাঁর দ্বারা কঠিন। এই দিকটা বাদ দিলে মনে হয় না তিনি প্রাচীনপন্থী ছিলেন। দর্শন কী- নিজে যে জানতেন এমন নয়, তবুও চিন্তা-ভাবনা ও বাক্যালাপে তাঁকে সেরকম একটা জায়গা থেকে দেখা যেতেই পারে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া নেই তাতে কী, তাঁর সন্তানদের জন্য এই বিদ্যা অর্জনকে কি না করে নিয়েছিলেন তাদের ভবিতব্য। তারা- আমরা ভাইবোনেরা এর কতটা অর্জন করেছি এখন বলতে পারি না। তবে এমন অনেক দিক আছে যেখানে তিনি আমাদের থেকে ভালোই জানতেন এটা স্বীকার করতে হয়। যদিও তাঁর সাথে এসব তর্ক ও আলাপ একটা সময় বাক্যবাণের ভেতর গিয়ে শেষ হতো, স্বভাবত ধৈর্যহীন আমি শোভন একটা আচরণের দিক থেকে তখন পরাজিতই হতাম। এইসব মুহূর্ত ছাড়াও আব্বাকে দেখেছি এই ধৈর্য ছিল তাঁর- বিশাল হাতিয়ার। অনেক সময় তাঁর নিজস্ব প্রতিরোধে এটা খুব সহজে যোগ করতেন যে, এখন এটা বুঝতায়নায় বা। এখানে তাঁর কাছে সময় ছিল বড় বলবান, মানবীয় অভিজ্ঞতার পুরোটা তো তার কীর্তি। তাঁর কথায়, হাতিও একটা সময়ে মশা হয়ে যায়।

 

এই মানুষটার অবশ্য আরেকটা পরিচয় ছিল, সেটা আমাদের গ্রামের লোকেরা তথা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে তিনি ছিলেন পীরসাহেব। এখানে তিনি সাংস্কৃতিক কেউ না, তাঁর দার্শনিকতাও দূরের জিনিস; সম্ভবত কিছুটা সম্মান ও ভালবাসায় তখন এভাবে উচ্চারিত হতেন। তাঁর যখন জন্ম হয়, জেনেছি তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সুস্থিরতার প্রশ্নটা ছিল তাই তাঁর কাছে জীবনব্যাপী অত্যন্ত মূল্যবান। এই সময়টাতে যদিও তাঁর ব্যক্তিজীবনে দুর্বিপাক কম ছিল না, যখন ৩/৪ বছর বয়স, হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর মাকে। তাই অস্থির এই সময়ে নিরাপদ আশ্রয়ের একটা সন্ধান তাঁকে অত্যধিক ব্যাপৃত করে তুলবে এটা স্বাভাবিক। বলতে গেলে রূঢ় এই বাস্তবের বাইরে তাঁর বড় শিক্ষক কেউ ছিল না। এখানে এই জীবনটাই তাঁর জীবনের লক্ষ্যকে নির্ধারণ করে নিয়েছিল। এখানে আমরা দেখি তারুণ্যে বাধাবন্ধনহীন সময়ে সামাজিক লোকপ্রজ্ঞাকে আয়ত্তে করতে তাঁর খুব অসুবিধা হয়নি। তখনকার নাইট স্কুলের কদিন বাদ দিলে মাওলানা রুমিসহ এমন অনেকের চিন্তাবিশ্বে তিনি অনুপ্রবেশে ছিলেন স্বচ্ছন্দ। কারণ অগ্রসর সান্নিধ্যকে তিনি উচ্চমূল্য দিতেন, তাঁদের সাহচর্যকে যাপন করতে ছিলেন প্রগাঢ় যত্নশীল ও অকৃপণ। তাঁর কাছে লোহাও তখন সোনা হয়ে যায়। এখান থেকে তাঁর অনুসন্ধানের বিষয় ও পৃথিবীকে কিছুটা বুঝতে পারা যায়। এখানে তাঁর কথাটা ছিল, সৎ ও ভালো মানুষের সঙ্গ নিতে হবে। বড়জোর এই একটা নীতি ও স্বাক্ষর জ্ঞান থেকে পৃথিবীর পাঠশালা বলি বা বিশ্ববিদ্যালয়- এর থেকে তিনি সাধারণ জ্ঞানকাণ্ডের অনেকটা আয়ত্ত ও অতিক্রম করে নিতে পেরেছিলেন।

 

এটা ঠিক যে, গুরুকৃত্য তাঁকে যে পথ দেখিয়েছিল, এখানে আমরা সে সাক্ষাৎ পাই। তিনি তাঁর মুর্শিদকে জেনে নিয়েছিলেন পথের দিশা বা পরশমনি। সেই সাহচর্যের জ্ঞান ও মধুতে তিনি কখনও নিস্পৃহ ছিলেন না। তবে কাজের থেকে হয়ে উঠেছিলেন অত্যধিক ভাবের মানুষ। যদিও একটা সময় কৃষির সাথে অল্পবিস্তর ব্যবসায়ীও ছিলেন, কিন্তু এখানে কি না লৌকিক নয়, আধ্যাত্মিক এই সাহচর্যে ভাববস্তুকে জীবনের ধ্রুবক করে নিয়েছিলেন। তাই বলে সংগ্রাম ও পরিবর্তনকে তিনি মান্য করতেন না তা নয়। অনেক সময় তাঁর স্বভাবসুলভ গল্পে আমাদের বুঝিয়ে দিতেন যে, এর মধ্যদিয়ে আসলে ‘দুইন্নাইটা’ পাল্টায়। এখানে কাজেই কাজী হয় মানুষ- এই ছিল তাঁর কথা। বলা বাহুল্য এটা ছিল সেই লোকপ্রজ্ঞা থেকে উদ্ধৃত- ব্যবহারিক বিশ্বের কথা যা কার্যত ভাববাদের বিপরীত একটা দর্শন বলতে আমরা বুঝে থাকি। এখানে শখের জ্ঞান নিশ্চয় জঞ্জাল বলে বিবেচিত হবে। আসলে যতই তিনি গুরুবাদী হোন, তাঁর কাছে জ্ঞান কেবল জ্ঞান ছিল না; ব্যবহারিক রূপে ছিল এটা পরিবর্তনকামী- শখের বস্তু নয়। আমরা- তাঁর সন্তানেরা এটা সযত্নে বেশ আয়ত্ত করি- চাইতেন তীব্রভাবে; আমরা কেবল নিজের নয়, সবার হয়ে যেনো যাপন করি মানুষের জীবন। মানুষের সেবা যে বড় ইবাদত- এটা ভুলে গেলে হবে না। এভাবে আব্বা সাংস্কৃতিক থেকে বৌদ্ধিক ও ভাবে একটা আড়ালসহ নিজেকে স্থাপন করে তাঁর সময় ও জীবনকে যাপন করে গিয়েছিলেন। তাঁর কাছে বড় মানুষ ছিল চরিত্রে যে বড়- সে।

 

এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে, কেন তিনি ব্যক্তিগত এই আড়ালকে এতো পছন্দ করতেন? এর বাস্তবিক কারণ ছিল এবং সেটা তাঁর জীবনে তত কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না । কৈশোরে এর কিছুটা ব্যাখ্যা তিনি করেছিলেন মনে হয়। ‘মানুষের জীবনে শৈশব হচ্ছে সবচেয়ে গুরিত্বপূর্ণ’; এই কথাটা অবশ্য রুশো’র। এখানে এর কতটা ছিল তাঁর জীবনে- সেটা একটা প্রশ্ন। বলতে গেলে তখনকার সময়ে তাঁর জন্য এটা ছিল সীমিত এবং জেনে গিয়েছিলেন যে, আমরা আসলে একটা হিংসা উন্মত্ত পৃথিবীতে বাস করি। যতটা মনে পড়ে, একবার বলেছিলেন, সোনাদানা মাইনষে লুকাইয়াই রাখে। তাহলে কেন নিজেকে আর জাহির করা! অহংকারকে দেখতেন সেরকম এক অপরাধ হিসেবে। এরকম কিছু অনুশাসন তিনি নিজের জীবনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। তাই অনেকের মধ্যে থেকেও তাঁর এই সামাজিক জীবনে বাস্তব পৃথিবীর মন্দ বলি বা পঙ্কিলতা- এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছিলেন, তাঁর গায়ে মাখতে দেননি। আমরা দেখেছি আব্বা স্বাস্থ্যের যত্ন নিতেন খুব, বলতেন এটা হলো সর্বসুখের মূল। পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন, সুগন্ধী ব্যবহারেও ছিলেন যত্নশীল। স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে কি না জানি না, তাঁকে শারীরিক অসুস্থতায় তেমন একটা ভুগতে হয়নি। ঠাণ্ডাকে অবশ্য ভয় করতেন, টুপি পড়ে থাকতেন সবসময়, শীতে একটার ওপর আরও একটা মাথায় চাপিয়ে নিতে দেখেছি। বলতে গেলে ঔষধ তাঁকে কমই খেতে হয়েছে। তবে এটা হবে ২০১৮ সালের আগের দিকের একটা ব্যাপার। পরবর্তীতে এই হিসেবটা আর এরকম থাকেনি, ডাক্তার দেখাতে হতো নিয়ম করে। এই সময়টাতে তাঁকে যখন আমরা একবার হাসপাতালে ভর্তি করি, তখন জানতে পারি তাঁর হার্টে অল্পবিস্তর সমস্যা আছে। সে ব্যবস্থাপত্রের বাইরে আর তাঁর আসার সুযোগ হয়নি। ঔষধ খেতেন, মাস বা দুইমাস পর ডাক্তার দেখাতে যেতে হতো। প্রথম দিকে যদিও এটা মেনে নিতেন না, তাঁর কাছে এটা ছিল কষ্টের। তাই গড়িমসি করলেও বোন সুফিয়া জাহানের শাসন তাঁকে মানতেই হতো, এছাড়া রওশনের তো ছিলই একটা অশ্রুপূর্ণ আবদার, সুমি’র তর্জন-গর্জনও কম ছিল না। তাই এই সময়ে সামি ও সালমানের জন্য তাঁকে ডাক্তারে নিয়ে যেতে অসুবিধা হতো না। সালমান তাঁর কাছে একটা সহায়-সম্বল হয়ে উঠেছিল, আর প্রশ্রয় ছিল একরম- তার বিরুদ্ধে কিছু বলা ছিল কঠিন। হুমায়ূনের প্রতি আব্বার অন্ধ সমর্থন তার কিছুটা ক্ষতি করেছে বলে মনে হয়।

 

এক রাতের কথা বলি, সে রাতে আমাদের কী কান্না- এখনও মনে পড়ে। রাত তখন ৩.৩০ হবে। সামি বাথরুমে গেলে দেখে সবকিছু তছনছ হয়ে আছে, এটাকে লণ্ডভণ্ডও বলা যায়। সামনের যে রুমটাতে আব্বা-আম্মা থাকেন, সেখানে দেখে আব্বা একটা চেয়ারে অস্বাভাবিক ভাবে পড়ে আছেন! তার চিৎকারে সবাই জড়ো হই, বুঝতে পারি দিনে যে ডাক্তার দেখানো হয়, তাঁর ঔষধপত্রের ভুল ডোজের প্রতিক্রিয়া হবে এটা। স্বাভাবিক হতে সময় নিলে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, তাঁকে আবার সেই ডাক্তারকে দেখানো হবে ভালো। এটা ছিল আসলে তাঁর ঘুমের ওভারডোজের ফল। যাইহোক সেবার দ্রুত তিনি মোটামুটি একটা ভালো স্বাস্থ্যে ফিরে এসেছিলেন।

 

আমাদের বাড়ির পাশে বাজার, তাই বাজারে না গিয়ে তিনি পারতেন না। এই সময়টাতে কি না তাঁর বাজারে যাওয়া আরও বেড়ে যায়। বড় মাছের প্রতি লোভ ছিল না বলবো না, এখানে হামিদেরা তো ছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে তারা শান্তিগঞ্জ এসে মাছের ব্যবসা করে। কখনও টাকা না নিয়েই আব্বাকে সেরকম বড়সড় কিছু গছিয়ে দেয়। বলতেন, জোর করে দিয়ে দিলো; বললো, চাচা টেকা লাগবে না। হামিদেরা জানতো, এটা সময় মতো তারা পেয়ে যাবে। এছাড়া দেখেছি তাদের এই চাচাকে তারা কম ভালবাসতো না। বক্কর তো ছিল, গ্রাম ও আশপাশের মুরব্বিরা এলে তাঁদের সাথে আলাপ ও গল্পে তিনি দিনগুলো কাটিয়ে দিতেন। আমাদের গ্রামেও যেতেন প্রায়ই, কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে দেখে আসতেন। কখনও ফিরে আসতেন আবার কারও বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে। বলতেন, আরজু ভাইদের কথা, না হয় জয়নালদের বাড়ি থেকে নাকি খেয়ে নিয়েছেন। তখন তাদের কী প্রশংসা!

 

এটাও খেয়াল করেছি যে, তিনি কখনও কারও মন্দ বলতেন না। তাঁর এই সাংস্কৃতিক জীবনে তিনি তীব্র একটা নৈতিক জীবন কাটিয়ে গেছেন। এছাড়া সমাজকে তাঁর আর কী দেবার ছিল? অবশ্য তাঁর একটা ধারণা ছিল জীবনের সংক্রামে, নিজে তো বলতে গেলে এখান থেকে উঠে আসা। এখন বলা যায় চারপাশের ক্ষেত্রে তিনি সেটা আমাদের জন্য রেখে গেছেন। তাঁর পরোপকার ও দরদের কথা বলার মানুষের সংখ্যা কম নয়। একটা সময় আমাদের গ্রামের লোকেরা যে বিদেশ যেতেন, তাঁদের অনেকে এখনও সেসব সাক্ষ্য দেবার কথা। এছাড়া নিৎসে যে বলতেন, সাহসই একমাত্র কল্যাণ, নিৎসে পাঠ না করেও তিনি আমাদের সেটা জানাতে ভুলতেন না। এখানে একটা বাঘ ধরে নিয়ে আসার তাগিদ ছিল তাঁর। আল্লাহ ছাড়া কোথাও নত হবার শিক্ষা আমাদের দেননি। বলতেন, যা চাওয়ার, আল্লাহর কাছে চাও। এখানে যোগ করে নিতেন, খাদিমদার জানে, কাকে কী বা কতটা দিতে হবে। মূলত এখানে তিনি আমাদের যোগ্য হয়ে উঠার কথা বলতেন। আমরা যে সামর্থ্যের সাপেক্ষে সবকিছু পাই, সে পাঠটা কি না তখন থেকে যেতো তাঁর কথার আড়ালে। এভাবে একটা ইশারা বা ইঙ্গিতে কিছু বলা হয়ে উঠেছিল তাঁর কথার বিশেষ ধরন বা গুণ।

 

সেই গুণে কি না মনে হয় তাঁর বন্ধুবলয় ও আড্ডাগুলোতে তিনি ছিলেন একটা প্রিয়মুখ। শিবপুরের চমক চাচা ও রণ দা’র বাবাও আজ বেঁচে নেই! তাঁর গুরু ভাইয়ের সংখ্যাও আমাদের গ্রামে কম ছিল না। সম্প্রীতির সবটা নিয়ে বলা যায় তাঁরা কাটিয়ে গেছেন তাঁদের জীবন। আব্বা তাঁর সন্তান হিসেবে আমাদের কাছে দাবি করতেন, আমরা যেনো মানুষ হই; নিখাদ মানুষ এবং সেটা মানুষের মতো মানুষ। এটা শুধু এদিক থেকে নয়, বিদ্যায়ও যেনো হই ‘বাহাদুর’- এই ছিল তাঁর দুর্মর অভিপ্রায়। এসবের বাইরে আমরা সামাজিক হবো, রপ্ত করে নিবো এমন অভ্যাসও- অপরকে সাহায্য করা এবং কখনও কারও ক্ষতি করা নয়। আমি যখন একটু আধটু দর্শন পাঠে পরিচিত হই, তখন খেয়াল করি, বাংলায় হিপোক্রেটিস নেই তো কী হয়েছে, আমাদের আছে সে নির্বিশেষ দর্শন এবং সেটা এই লোকপ্রজ্ঞা। এখানে আব্বা লেখাপড়া না জানলেও এমন প্রজ্ঞানে ছিল তাঁর সহজাত অধিকার বলতে পারি। তবে সবকিছুর মতো এসবও ছিল তাঁর আড়ালের ধন, লোক দেখানোকে একদম পছন্দ করতেন না, সরাসরি মন্দই বলতেন। যেহেতু তিনি বলতেন কম, তাই বাক-সংযমের এই মানুষের ইশারা ও ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা থেকে সম্ভবত আমরা- তাঁর বন্ধুসমেৎ একটু বেশিই শুনতে পেতাম। সে কারণেও হতে পারে তাঁর সান্নিধ্য ও আলাপ ছিল অনেকের কাছে লোভনীয় ব্যাপার মনে হয়।

 

আমি বেশ দেরিতে এসব বুঝতে শিখি। এখন কোথাও বয়স্ক লোকদের দেখলে তাঁর অবয়বটা চোখে ভেসে উঠে, তাঁদের প্রতি বিনীত শ্রদ্ধায় তাঁর প্রতি না বলা কথা ও দায়টুকু শোধ করি। এটা কিছুটা সুবিধাবাদের মতো শোনাতে পারে, নৈতিক দিক থেকে এই শিক্ষাটা কিন্তু তাঁরই- বড়রা যে হোক, তাঁদের শ্রদ্ধা করতে যেনো আমরা ভুলে না যাই। এভাবে জীবনকে ভালবাসার শিক্ষাটা আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিলাম। বৈষয়িক বিশ্বে তিনি ছিলেন আসলে নিস্পৃহ ও সরল মানুষ। নিজে তত সঞ্চয়ী ছিলেন না, তবে আমাদের বলতেন, এই অভ্যাসটা যেনো করি। এটা বুঝতে শিখি যে, ১টাকার অভাব থাকলে ১০০ টাকা হয় না। মনে পড়ে ২১ শে কোন এক কারণে তাঁর উৎকণ্ঠিত হবার কথা ছিল, কিন্তু দেখেছি এর কিছু স্পর্শ করেনি। তখনও স্বাভাবিক ভাবে ধরে রেখে গেছেন তাঁর প্রশান্তি। এখানে ২২ অবশ্য তাঁকে আর সে সুযোগ দেয়নি, ১৫ জানুয়ারির পর থেকে বাইরে যেমন-তেমন অটুট মনে হলেও ভেতর থেকে ভেঙে পড়তে থাকেন। চিকিৎসাধীন তো ছিলেন। এবার মনে হলো তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ভালো হবে। অন্তত বেড়ানোর ফুরসতে চাঙা হয়ে উঠবেন। সে নিরিখে তাঁকে ২৯ জানুয়ারিতে ওসমানীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু একজন সুস্থ মানুষ বলতে গেলে এরপর থেকে অত্যধিক অসুস্থই হয়ে পড়েছিলেন। এটা-সেটা কত পরীক্ষা করা হলো, সেরকম চিকিৎসাও চলছিল তাঁর। রাত তখন দুইটা পেরিয়ে গেছে। এবার চেষ্টা করেছিলাম কোথাও আইসিইউ বেড পাওয়া যায় কিনা। সে রাতে সেটা আর হয়নি। আমি ও সামি তখন আব্বার হাত দুটো ধরেই ছিলাম। একসময় দেখলাম উঠে বসতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। তারপর যা বললেন, এর মর্মবস্তু হতে পারে আমরা যেনো সবসময় হাত ধরে থাকি। এখানে ঈশপ যা বলেছেন, ‘একতাই বল’ এটা ছিল মনে হয় তাঁর কথা। এরপর মাথাটা একটু এলিয়ে দিলেন, ঢেঁকুর তুলার মতো একটা শব্দ শুনতে পেলাম। সামি বললো, বড় ভাই, আব্বার বুক তো এখন উঠানামা করে না। আমি তাঁর বুকে হাত রাখলাম। দেখলাম চিরদিনের মতো তিনি নিস্পন্দ হয়ে গেছেন!

 

সে রাতে আমরা হারালাম আমাদের পিতা ও অভিভাবককে; আমাদের বটগাছ এবং দার্শনিক টাইপ এই ভালো মানুষটিকে। তাঁর কথা আমরা ভুলি কী করে!

 

এনামুল কবির- অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত), শাহজালাল মহাবিদ্যালয়, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published.

© All rights reserved © 2017-2023 Jagannathpurnews.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com