বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ অপরাহ্ন
ছায়াদ হোসেন সবুজ
শহীদ আরশ আলী মনে হবে এক অখ্যাত বীর; কিন্তু এই মানুষটি যুদ্ধের মাঠে ছিলেন যেমন অকোতভয়, তেমনি তাঁর সাক্ষ্যটা ছিল যুদ্ধ করতে করতেই তিনি সেদিন শহিদ হয়েছিলেন। সেদিন তারিখটি ছিল ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
বীর মুক্তিযুদ্ধা এই আরশ আলীর জন্ম ১৯৫২ সালের ৫ ই ডিসেম্বর; জায়গাটি আবার সুপরিচিতই- সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নে। তাঁর গ্রামের নাম -আস্তমা। এই গ্রামটি নাইন্দা নদীর তীরবর্তী। বাবা ইদ্রিস আলী ছিলেন খুবই সহজ সরল প্রকৃতির; আর মা ময়না বিবি ছিলেন সাহসী ও ত্যাগী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আরশ ছিলেন প্রথম; অপর দুই ভাই- হাসিম আলী ও সামছুল হক, এবং তাঁর-দুই বোন দিলারা বেগম ও হুসনারা বেগম।
সামছুল হক ২ বছর আগে মারা গিয়েছেন। এখানে আরশ আলীর যুদ্ধদিনে উপস্থিতিত হওয়া আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পৃথক কোন কাহিনী ছিলনা। দেখা যাবে আমাদের অহংকার এই আরশ আলীও একই স্রোতধারায় গিয়ে মিশেছেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হলেন সেই প্রেরণা যার ৭ ই মার্চের ভাষন শুনে যুদ্ধ দিনের মাঠে গিয়ে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। ত্যাগ করতে পেরেছিলেন জীবনের মায়া; অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন আমাদের জাতীয় এই মুক্তিসংগ্রাম আর স্বাধীনতা যুদ্ধে। দুঃখ জনক হল তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি; ১৫ সেপ্টেম্বর, বাবনিয়া যুদ্ধে শহিদ হন। বাবনিয়া গ্রামে আখরা লাগোয়া এই যুদ্ধে সময়টা ছিল তখন আনুমানিক ৫ টা। বলাবাহুল্য আরশ আলী শেষ নিঃশ্বাস টুকু থাকা পর্যন্ত খুব দক্ষতার সাথে সেদিন যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন।
শাহাদাৎ বরনের পর আরশ আলীকে দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া নামক গ্রামে’র দক্ষিণের হাওর তথা আহমদপুর মৌজা নামক টিলাতে তাকে সমাহিত করা হয়। আমরা জেনেছি যার তাজা রক্তে এদেশ এখন স্বাধীন,সেই আরশ আলীর কবরস্থানে নাকি কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই!
সেদিন আরশ আলী ও তাঁর পরিবারের খবর জানতে তাঁর গ্রাম- আস্তমাতে গিয়েছিলাম। এই গ্রামটি উপজেলা থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে, যেতে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগে না।
আমি মোটর সাইকেল করে সেখানে গিয়েছিলাম। দেখছিলাম রাস্তার দু’দিকে ধানি জমি, অবশ্যই এখন ফাঁকা, চারদিকে এখন পানি আর সবুজের ছড়াছড়ি, অদূরে পার্শবর্তী গ্রামগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার দাড়াই আর দেখি সূর্যটা আজকের দিনের মতো বিদায় নিতে তোড়জোর করছে। এই গ্রামে আমি আগে আসলেও এমন চিন্তা নিয়ে যেমন আসিনি তেমনি শহিদ আরশ আলী কে বা তাঁর বাড়ী সম্পর্কেও খোঁজ নেইনি। আমার বিশ্বাস ছিল এমনই একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ী খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কিছু হবেনা।
কিন্তু ব্যাপারটা দেখছি তেমন সহজও নয়। ছোটখাটো একটা দোকানের কাছে আসতেই এক যুবককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই শহিদ আরশ আলীর বাড়িটা কোন দিকে? তিনি প্রতি উত্তরে যা বললেন,তা হল ভাই শহিদ আরশ আলীর বাড়ি আমি চিনি না। আমি এমনটা শুনব প্রস্তুত ছিলাম না;তাই হতভম্ব হয়ে ভাবি যে, আরশ আলী হলেন এই ভাটি বাংলার একজন অকুতোভয় বীর; আর এই লোকটা একই গ্রামে হলেও আরশ আলীর বাড়ি চিনে না! এর চেয়ে আমাদের লজ্জার কি হতে পারে? যাই হোক আমি হাঠছি শহিদ আরশ আলীর বাড়ির সন্ধানে। একটু এগুতেই পেলাম সাদা দাড়িওয়ালা এক প্রবীণ মুরব্বিকে; জিজ্ঞেস করলাম, শহিদ আরশ আলীর বাড়িটা কোনদিকে? তিনি উল্টো শুধালেন, “আরশ আলীর বাড়ী যাইবেন?” আমি মাথা নাড়লাম এবং বুঝলাম এই গ্রামে শহিদ আরশ আলীর অবস্থান। হাটতে হাটতে হঠাৎ উপস্থিত হলাম শহিদ আরশ আলীর বাড়িতে। অবশ্য এখন সেটা অন্য আরেকজনের বাড়ি। জানা যায়,এই বাড়িটি অনেক আগেই শহিদ আরশ আলীর বাবা বিক্রি করে গেছেন।
এখানে এখন এক বিশাল অট্রালিকা। কিছু জানা বা বুঝার মত কোন অবস্থা সেখানে নেই। আছে শুধু পুরনো স্মৃতি। একটা বিষয়ে নিশ্চিত হলাম, আস্তমা গ্রামে আরশ আলী এখনো এক অবহেলিত নাম। কিন্তু আস্তমাবাসী জানেনা তাদের গর্ব আস্তমার মাটি ধন্য করা অকুতোভয় বীর শহিদ মুক্তিযুদ্ধা আরশ আলীর জন্যই এই আস্তমা গ্রামের এত সুনাম। শহীদ আরশ আলীর মত একজন দেশরত্নের প্রতি গ্রামবাসীর অজ্ঞতা বুঝতে পেরে মনে হতাশা আর কষ্ট নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি।
পরদিন জানতে পারলাম শহিদ আরশ আলীর পরিবার বলতে তাঁর এক ভাই দক্ষিণ সুনামগঞ্জ হ্যাচারীর পাশে এক কূড়ে ঘরে বাস করেন। সাথে সাথেই চলে যাই ওখানে। উপস্থিত হলাম আরশ আলীর ছোট ভাই হাসিম আলীর বাড়িতে। দেশ থেকে সাঁকো বিলীন হলেও ওখানে পেলাম একটা। গোটা দেশ বিদুৎএর আলোয় আলোকিত হলেও আরশ আলীর পরিবার এখনো আধারে ডুবে আছে। এখানে নেই কোন বিদ্যুৎ, নেই কোন সোলার প্যানেল, হারিকেনের আলোই তাদের সম্বল। আমি দরজায় গিয়ে ডাক দিতেই বের হলেন সহজ-সরল লুঙ্গি ও ছেঁড়া শার্ট ওয়ালা এক যুবক। জিজ্ঞেস করলাম,এটা কি শহিদ আরশ আলীর পরিবারের বাড়ি? প্রতি উত্তরে বুঝলাম,এটা আরশ আলীর পরিবার।
ঘরে ডুকতেই দেখতে পেলাম একাত্তরের বীর শহিদ আরশ আলীর ছোট ভাই হাসিম আলীকে। হাসিম আলীর এক ছেলে;নাম-এমদাদুল।এই এমদাদুলের এখন দুই ছেলে ইজাজুল ও এমদাদ। শহিদ আরশ আলীর বেঁচে থাকা ছোট ভাই হাসিম আলী, ময়লা কাদা যুক্ত এক পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে বসে আছেন, ঘরের এক কূনে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কে বাবা? আমি বললাম আমি একজন সাংবাদিক; আপনাদের দেখতে এসেছি। তিনি বললেন, আমাদের কে দেখে বাবা! তখন আমি বললাম, আচ্ছা চাচা শহিদ আরশ আলীর জীবনের কিছু স্মৃতি ও আপনাদের পরিবারের বর্তমান অবস্থার কথা বলেন তো। একথা বলার সাথে সাথেই তিনি কেঁদে ফেললেন; আর বলতে লাগলেন, ‘আরশ আলী আমার বড় ভাই, তিনি দেখতে খুব সুন্দর ও সাদা মনের মানুষ ছিলেন। তিনি সাহসী ছিলেন, ছোট বেলায় দুই ভাই একসাথে কত চলেছি! কত স্মৃতি আমাদের!তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের সবার বড়।
দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার ভাই আমাদের পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে দেশ স্বাধীন করতে চলে গেলেন, আর এই বিদায়ই ছিল আমার বড় ভাইয়ের শেষ বিদায়। আমার ভাই যুদ্ধে শহিদ হলেন।’ পরিবারের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমার ভাই তার তাজা রক্ত দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। আর এ দেশে আমরা না খেয়ে, শত কষ্টে দারিদ্রের মধ্যে মরে যাচ্ছি, আমাদের দেখার কেউ নাই।
আমরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত, সরকারি বেসরকারি কোন প্রকার সাহায্য আমরা পাইনা। দুবেলা দু’মুঠো ভাত ও আমাদের কপালে জুটেনা। আমি বৃদ্ধ মানুষ, কোন কাজ করতে পারিনা। আমার সহজ-সরল ছেলেটা এখন মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে পরিবার চালায়। পরিবারে আমরা ৬ জন মানুষ কি করুন জীবন যাপন করছি কেউই তা কখনো জানতেও চায়নি। তিনি আরও বলেন দেশ তো পেয়েছি, কিন্তু আগে যে কষ্ট করতাম এখনও তাই করি। অভাব তো ছাড়ে নাই। দেশ উন্নত হয়েছে অনেক। এটা ভালো লাগে।
কিন্তু আমাদের জীবন তো বাবা দেশের মত নাই। আমরা যেমন আছি তেমন। দেশে এখন অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারী অনেক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু আমরা সঠিক মুক্তিযুদ্ধা পরিবারের সদস্য হয়েও কোন সুযোগ সুবিধা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। তাই সরকারের কাছে আবেদন, আমাদের মত অসহায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে যেন কিছু হলেও সাহায্য করা হয়।
আজ সেই ১৫ সেপ্টেম্বর;ক বছর ধরে এই দিনটি বিভিন্নভাবে তাকে স্মরণ করা হয়। স্থানীয় শহিদ মিনারে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভার। আজকেও হয়তো ব্যাতিক্রম হবেনা; কেউ না কেউ এই দিনটি পালনের জন্য এগিয়ে আসবেন। আরশ আলীর এই শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
Leave a Reply