বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ অপরাহ্ন
জগন্নাথপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের অদূরে হাতের ডানদিকে; কলকলিয়া ইউনিয়নের হিজলা গ্রামের পূর্বদিক। জগন্নাথপুুর হাসিমাবাদ এলাকার নলজুুর নদীর এপারে এক মনোরম পরিবেশে সূর্যমুখী বাগান দৃশ্যমান। জগন্নাথপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের ডানদিকে নেমে বাগানের কাছাকাছি গেলে অপরুপ এক নান্দনিক ও ছিমছাম পরিবেশ লক্ষ্যনীয়। মূল সড়কে গাড়ির যাতাযাত, ফাগুনের পাতা ঝড়া সারি সারি গাছ-গাছালি, পাক-পাখালীর কূজন, বাগানের সম্মুখে মৃত নলজুর নদী খননে মাটির টিলাটালা, নদীর ওপাড়ে টিনচালার ঘর, পিংলার হাওরের ধান ক্ষেত, ছোট ছোট ঝোপঝাড়,সমতলে সবুজ ঘাস, দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ ও ডানে-বামে বিস্তৃত হাওরের ধান ক্ষেত; এ যেন এক মনমাতানো দৃশ্য।
কিছুদিন আগে এই স্থানে স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের সরিষা বাগান ছিল। তখনও দর্শনার্থীদের বারবার কাছে টানে- ফুলে ফুলে ভরপুর এক একটি সরিষা বাগান। সরিষার দিন ফুরিয়ে এলে কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় স্থানীয় ২ জন কৃষক মনোরম এই স্থানে অতি লাভজনক সূর্যমুখী ফুল চাষে উৎসাহিত হন।
তারা হচ্ছেন- জগন্নাথপুর পৌর এলাকার ৬ নং ওয়ার্ডের জগন্নাথপুর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা কৃষক শামিম আহমেদ ও ওয়াসিম মিয়া ।
এমন ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ নিয়ে তারা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে বীজ ও সার নেন। চলতি বছর তারা হাসিমাবাদের উত্তরে নলজুর নদীর এপাড়ে মনোরম স্থানটি নির্ধারণ করেন এবং মালিকানাধীন ৫ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেন। ইতোমধ্যে গাছে গাছে ফুল ফুলে ভরপুর।এক একটি ফুল যেন শির উচুঁ করে সূর্যের আলো ছড়াচ্ছে। ভালোবাসার এক অপূর্ব মায়াবি মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে দর্শনার্থীদের পানে। চারিদিকে হলুদ রঙের ফুলের অপরূপ দৃশ্য। হলুদের আভায় চারিদিকেই যেন ছড়িয়ে আছে অপার মুগ্ধতা। ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌমাছির দল। এ যেন এক নান্দনিক দৃশ্য। সবুজের মাঠে হলুদের রাজ্যটি দেখতে মৌসুমে ভিড় জমাচ্ছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। প্রতিদিন উপজেলার প্রত্যন্ত স্থান থেকে সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষ সূর্যমুখী ফুলের বাগান দেখতে আসছেন। বিকেল হলে সকল বয়সের নারী-পুরুষের আড্ডায় ভরপুর অপরুপ এই স্থান। কেউ ছবি তুলেন, কেউ সেলফিতে মগ্ন থাকার দৃশ্য লক্ষ্যনীয়। আবার কেউ কেউ কেট করে সন্তানের জন্মদিন পালন করতে দেখা যায় অপরুপ এই মনোরম পরিবেশে।
সূর্যমুখী বাগান নিত্যদিন দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন কৃষক শামিম আহমেদ এর ভাই মোঃ ফয়সল আহমেদ শাকিল।
শাকিল জানান, “প্রতিদিনই জগন্নাথপুর পৌর শহর ও উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন আসে সূর্যমুখী ফুলের বাগান দেখতে।” সূর্যমুখী চাষ করতে তাদেরকে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লাভবান হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, “দর্শনার্থীদের ভীড় এ স্থান বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিনত হয়েছে। তবে কিছু অসাধু দর্শনার্থী ফুল ছিড়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
শাবিপ্রবি’র ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সূর্যমুখী বাগানের দর্শনার্থী এম. শামীম আহমেদ বলেন, “জগন্নাথপুরে সাধারণত মৌসুমী ফসল ও ছোট পরিসরে সবজি চাষ হয়। এ বছর ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হিসেবে সূর্যমুখী ফুল ও সরিষা চাষ স্থানীয় মানুষের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপণা জাগিয়েছে। আশা করি, সঠিক পরিচর্যা ও বাণিজ্যিক মূল্যয়ন পেলে জগন্নাথপুরের প্রান্তিক কৃষকেরা এমন ব্যতিক্রমী চাষাবাদে আরো উৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি স্থানীয়দের আনন্দ-বিনোদনে সুস্থ মাধ্যম হিসেবে অবকাশ কাটানোর সুযোগ মিলবে।”
জগন্নাথপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়িতা দাশ প্রমি বেড়াতে আসেন সূর্যমুখী বাগানে। প্রমি বলেন, “সূর্যমুখী বাগানে এসে খুব ভালো লেগেছে। আশপাশের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে আমাদের।”
জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, অল্প সময়ে কম পরিশ্রমে ফসল উৎপাদন ও ভালো দাম পাওয়া যায় বলে কৃষকরা এখন সূর্যমুখী চাষ করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে ১ কেজি বীজ দিতে হয়। দেড় ফুট অন্তর অন্তর একটি করে বীজ বপন করতে হয়। একটি সারি থেকে আরেকটি সারির দূরত্ব রাখতে হয় দেড় ফুট। মাত্র ৮৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে বীজ বপন থেকে শুরু করে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। প্রতি একর জমিতে সব খরচ বাদ দিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হয়। যা অন্য কোনো ফসলের চেয়ে কম পরিশ্রমে ভালো আয়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, সূর্যমুখীর তেলে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নেই। এ ছাড়া ঝাঁঝযুক্ত ক্ষতিকর লিনোলিক অ্যাসিডও থাকে না। বরং ওই তেলে স্বাস্থ্যকর ‘ইরোসিক অ্যাসিড’ থাকে। এক কেজি সূর্যমুখীর বীজে ৪০০ থেকে ৪৫০ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। সরিষায় মেলে ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্রাম। ফলে সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের বেশ আগ্রহ রয়েছে।
এ বিষয়ে জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত মজুমদার বলেন, “চলতি বছর জগন্নাথপুর উপজেলার আরো অনেক সূর্যমুখী চাষ করা হচ্ছে। তবে সূর্যমুখীকে ফুল হিসেবে চাষ করা হচ্ছেনা, বরং ফসল হিসেবে চাষ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দিন দিন ভেজাল তেল খেয়ে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। এই ফুলের তেল স্বাস্থ্যের জন্য অত্যান্ত ভালো হওয়ায় সরকার গুরুতর সহকারে উদ্যোগ নিয়েছে। ‘সূর্যমুখী চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে বিনামূল্যে উন্নত জাতের হাইসান-৩৩ জাতের বীজ ও উন্নত মানের সার দেওয়া হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে ৫ মণ সূর্যমুখী ফুলের বীজ পাওয়া যাবে। কৃষকদের স্বাবলম্বী করতেই সূর্যমুখী ফুল চাষে উৎসাহিত করা হয়েছে। যদি সফল হওয়া যায় আগামীতে সূর্যমুখীর চাষে অপার সম্ভাবনা রয়েছে।”
Leave a Reply