শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৬ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
সেমিনারে তারেক রহমান; আগামীর বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীও স্বেচ্ছাচারী হতে পারবে না জগন্নাথপুরে কিশোর হত্যা মামলার প্রধান আসামীসহ গ্রেপ্তার ২ ৩য় বারের মতো জগন্নাথপুর উপজেলা জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হলেন মাওলানা লুৎফুর রহমান জগন্নাথপুরে মসজিদ কমিটি কে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংর্ঘষে বৃদ্ধ নিহত, আহত ৩৫ যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির ও এম এ ছাত্তার এর স্বদেশ আগমন সিলেটে মুনতাহা হ ত্যা কা ণ্ড : চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল পুলিশ জগন্নাথপুর প্রেসক্লাবে  দ্বিতীয় ধাপে প্রাথমিক সদস্যপদ প্রদান জগন্নাথপুরে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার জগন্নাথপুরে কিশোরকন্ঠ মেধাবৃত্তি -২৪ সম্পন্ন জগন্নাথপুরে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে জনশক্তি সমাবেশ

চোখের জলে বজলুল মজিদ চৌধুরীকে শেষ বিদায়

চোখের জলে বজলুল মজিদ চৌধুরীকে শেষ বিদায়

জগন্নাথপুর নিউজ ডেস্ক :: একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু সুনামগঞ্জে স্বনামে পরিচিত। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এই মানুষটি ছিলেন আপাদমস্তক সজ্জন এক প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। সুনামগঞ্জ শহরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে ভরসা আর অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে আস্থার নাম ছিলেন তিনি। ছিলেন নতুন প্রজন্মের কাছে প্রভাব বিস্তারকারী ও অবিভাবকতুল্য। তাঁর অকাল প্রয়াণ মেনে নিতে পারছেন না স্বজন, অনুরাগী, সহযোদ্ধাসহ সর্বসাধারণ। জাতিরাষ্ট্রের জন্মযোদ্ধার এমন বিদায়ে মর্মপীড়ায় ভুগছেন তারা।

কিন্তু ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ এই শাশ্বত ভাবনা থেকেই একাত্তরের বীর যোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরুকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানানো হয়েছে। প্রশাসনও লাল পতাকায় মরদেহ মুড়িয়ে বিউগলের করুণ সুরে গার্ড অব অনার দিয়েছে। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য যেখানেই এই বীরের মরদেহ নেওয়া হয়েছে, সেখানেই ছিল মানুষের ভিড়। শেষ শ্রদ্ধা ও বিদায় জানানোর জন্য শোকাহত মানুষজন জড়ো হয়েছিলেন। কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা উজার করে দিয়েছেন তারা।

সকাল ১০টায় প্রয়াতের বাসভবন ‘অপেক্ষা’ থেকে মরদেহ বহনকারী গাড়িতে করে তাঁর নিথর দেহ নিয়ে আসা হয় জনগণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। যে বাসভবন প্রতিদিন তাঁর অপেক্ষায় থাকত, সেখান থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে আসছিলেন তিনি। তাই স্বজন ও প্রতিবেশীরা বাঁধভাঙা ডুকরে ওঠা কান্নায় বিদায় দেন। বাসভবনে তখন এক অন্যরকম শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

সেখান থেকে মরদেহ তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল জেলা আইনজীবী সমিতির সামনে সহকর্মীদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নিয়ে আসা হয়। বুক পকেটে কালো শোকব্যাজ ধারণ করে দীর্ঘদিনের সাথীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তারা নীরবে চোখ মুছছিলেন। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তিনি আর তাঁর প্রিয় কর্মস্থলে কখনও আসবেন না, পশ্চিমের কর্নারে বসবেন না- এটা মেনে নিতে পারছিলেন না তারা। তারপরও কিছুক্ষণ পর সহকর্মীকে অশ্রুসজল বিদায় জানান তারা।

সেখান থেকে আবারও শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেলা ১১টায় সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয়। সেখানে সর্বস্তরের জনতা, সংস্কৃতিকর্মীসহ সুধীজন শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা জানাতে আসা লোকজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শোকবিনিময় করেন। তারাও এই যোদ্ধাকে বিদায় জানাতে এসে কাঁদেন।

তারপর বেলা সোয়া ১১টায় একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় ঠিকানা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয় মরদেহ। সেখানে কালো মুজিব কোট পড়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের সহকর্মীকে বুকফাটা কান্নায় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানান। প্রিয় সহযোদ্ধাকে শেষবারের মতো সজল চোখে দেখে নেন সবাই। তাঁরা নিথর মরদেহ দেখে একাত্তরের যুদ্ধদিনের স্মৃতি রোমন্থন করেন। দুপুর ১২টায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সুনামগঞ্জ পৌরসভা চত্বরে। সেখানে পৌরসভার সর্বস্তরের নাগরিকবৃন্দ তাদের অবিভাবকতুল্য বয়োজ্যেষ্ট এই নাগরিককে শেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানান।

এভাবে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরুকে শহরের সর্বস্তরের মানুষ অশ্রুমাখা ফুলেল ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানান। বেলা সোয়া ১টায় সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহে নিয়ে যাওয়া হয় মরদেহ। সেখানে সুনামগঞ্জসহ জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে আগত অনুরাগীরা জানাজার নামাজের মাধ্যমে শেষ বিদায় জানান তাঁকে।

এর আগে এই বীর যোদ্ধাকে সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড ও বিভিন্ন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড শেষ শ্রদ্ধা জানায়। সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান মানিকের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগ, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের পক্ষে সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখতসহ বিশিষ্টজনেরা, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমানের পক্ষে পৌর মেয়রসহ দলীয় নেতারা শ্রদ্ধা জানান। সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ’র পক্ষে দলীয় নেতারাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও আলাদাভাবে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু গতকাল বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা আড়াইটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সাত দশকের জীবন ছিল গৌরব ও সৌরভে ভরপুর। প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে রাজনীতিতে আসেন তিনি। এই সচেতনতা থেকেই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ছাত্রাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে সম্মুখযুদ্ধ। অক্টোবর থেকে তিনি সেলা সাবসেক্টরের প্রশাসনিক দায়িত্বপালন করেন। যুদ্ধজয়ী এই বীর বিজয়ী হয়ে আবারও পড়ালেখায় মনোযোগী হন। স্বাধীনতার পরে পশ্চিম জার্মানিতেও কিছুদিন থাকেন। পরে দেশে ফিরে আইনপেশায় যুক্ত হন। এছাড়াও তিনি আশির দশকে প্রভাবশালী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। এসময় তিনি ‘দৈনিক পূর্ব দেশ’ ও ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। আশির দশকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সুনাম’ বের করেন। তাঁর মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ’, সমর নায়কদের নিয়ে ‘সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘পশ্চিম জার্মানির স্মৃতি’ সহ একাধিক মৌলিক বই রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর ‘রক্তাক্ত একাত্তর’ সুনামগঞ্জের সবচেয়ে মৌলিক ও নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স বই হিসেবে সমাদৃত। তিনি সাংবাদিকতা থেকে দূরে সরে গেলেও নিয়মিত স্থানীয় পত্র–পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। সর্বশেষ তিনি গত কয়েকবছর ধরে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। এতে রাষ্ট্র, ব্যক্তি, সমাজ, স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নোট করতেন বলে জানা গেছে।

বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু ১৯৯১ সালে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ২০০০ সালে সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। তিনি ২০০৭ সালে পাবলিক প্রসিকিউটরেরও দায়িত্বপালন করেন। দোয়ারাবাজার উপজেলার ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হেলাল খসরু হাইস্কুল’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি সেক্টর কমান্ডার ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ ৭১ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি এবং মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র সুনামগঞ্জের আহ্বায়ক ছিলেন। আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে গেছেন। শেষ বিদায় জানাতে আসা লোকজন তার কর্মময় জীবনের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published.

© All rights reserved © 2017-2023 Jagannathpurnews.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com