শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:৩৪ অপরাহ্ন
জগন্নাথপুর নিউজ ডেস্ক::
সময় নিয়েও সময় দিলেন না সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম! দেশে ফিরে এমপি হিসেবে শপথ নেবেন বলে তিনি সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হল না। সবার অগোচরে আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কাণ্ডারি সৈয়দ আশরাফ চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তারা সৈয়দ আশরাফের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের লাশ আগামীকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে দেশে আনা হবে।
সৈয়দ আশরাফের ব্যক্তিগত সহকারী একেএম সাজ্জাদ আলম শাহিন বৃহস্পতিবার রাতে যুগান্তরকে জানান, সৈয়দ আশরাফের এক ভাই ছাড়া পরিবারের সবাই এখন লন্ডনে।
সেখান থেকে তারা শুক্রবার দেশে ফিরবেন। এরপর লাশ দাফন ও অন্যসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের কয়েক সিনিয়র নেতা জানান, তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, আগামীকাল (আজ) তার মরদেহ দেশে আনা হবে।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আশরাফ। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকায় বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি শপথগ্রহণ করতে পারেননি।
শপথ নেয়ার জন্য সময় চেয়ে তিনি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। বুধবার স্পিকারের দফতরে তার ওই চিঠি পৌঁছে। এ বিষয়ে শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘উনার চিঠি পেয়েছি। উনি দেশে ফিরে আসার পর শপথ নিতে চান। আর এমনিতেই ৯০ দিন সময় উনি পাবেন।’
মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন।
ব্রিটিশ-ভারতীয় শিলা ঠাকুরের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শিলা ঠাকুর লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন এবং ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মেয়ে রিমা ঠাকুর লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকরি করেন।
১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সদস্য সৈয়দ আশরাফ ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা হলে সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্যে চলে যান। লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাসকালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন এবং যুবলীগের সদস্য হিসেবে লন্ডনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ফেডারেশন অব বাংলাদেশি ইয়ুথ অর্গানাইজেশনের শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে সৈয়দ আশরাফ ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। তিনি ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। এক মাস এক সপ্তাহ দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তাকে।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে সৈয়দ আশরাফ প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত সৈয়দ আশরাফকে চিকিৎসার জন্য নভেম্বরে লন্ডনে নেয়া হয়। পরে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
অসুস্থতার কারণে তিনি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। দেশে না থেকেও সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা) আসনে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা স্বয়ং সৈয়দ আশরাফের জন্য ভোট চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে।
জেলার নেতাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যেহেতু এখানে সৈয়দ আশরাফ অসুস্থ, সবাই মিলে তার জন্য কাজ করে যাবেন, যেন তিনি নির্বাচনে জয়ী হন। সুস্থ হয়ে তিনি যেন আমাদের মাঝে ফিরে আসেন এই দোয়া করছি।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন শেখ হাসিনার দুঃসময়ের সহযাত্রী, একজন নির্ভরযোগ্য ও আস্থাভাজন মানুষ। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গ্রেফতার হলে সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি দলের হাল ধরেন। দলকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রাখেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের যে খেলা তখন চলেছিল তার বিরুদ্ধেও তিরি সোচ্চার ছিলেন তিনি। ওই বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে পরে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব করেন। দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সালের কাউন্সিলে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীতে নিয়ে যান শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালে ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমি সন্তান, আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যদি ব্যথা পায়, আমিও বুকে ব্যথা পাই।
আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী যদি ব্যথা পায় আমারও হৃদয়ে ব্যথা লাগে! আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগই, এটা কোনো দল না, আওয়ামী লীগ আমার কাছে একটা অনুভূতির নাম।’ ২০০৯ সাল থেকে নানা ঘটনা এবং ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনের মধ্যে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পাশাপাশি আশরাফের ভূমিকার কথা গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করেন দলটির কর্মীরা।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক : বৃহস্পতিবার রাতে এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। জনগণ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তার অবদানের কথা চিরকাল স্মরণ করবে।
অপর এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন মহৎ-প্রাণ, সৎ, নীতিবান, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারাল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হারিয়েছে একজন আদর্শবান-ত্যাগী-নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অগ্রযাত্রা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অভিযাত্রায় ইতিহাসের ধ্র“বতারা হয়ে বেঁচে থাকবেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের শোক : এক শোকবাণীতে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন নির্লোভ রাজনীতিবিদ। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারাল। এছাড়া ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং চিফ হুইপ আসম ফিরোজ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
মন্ত্রিবর্গের শোক : সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক, এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহাম্মদ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল, পানি সম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. মশিউর রহমান রাঙ্গা, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব।
সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর খবর অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকে মুহ্যমান ও কান্না জড়িত কণ্ঠে অনেকে বিস্তারিত জানতে দৈনিক যুগান্তর কার্যালয়ে ফোন দেন। নিমিষেই ফেসবুক পোস্টে ভাইরাল হতে থাকে সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর খবর। রাতেই টেলিভিশন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয় সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর খবর।
Leave a Reply